২১ নভেম্বর ২০১৮, ২০:০১

বুকে ছুরি মুখে হাসি, চোখে নেই জল

চোখে-মুখে বিন্দুমাত্র হতাশা নেই। সরকারি কর্মকর্তা হতে চায় সিয়াম

জীবনযুদ্ধে হার না মানুষদের গল্পগুলো এমনই। ঠিক যেমন হালের গায়িকা কৃষ্ণকলি গেয়েছেন, ‘বুকে ছুরি মুখে হাসি, চোখে নেই জল’। কিন্তু দু’চোখ না থেকেও ঢাবি শিক্ষার্থী হাসনাতের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, ফেনির পা’হীন আব্দুল্লাহ’র জাহাজে কাজ নেয়া কিংবা শেরপুরের অন্ধ মনিরের রিক্সা চালানো— সবই তো যুবক-বুড়োদের যুদ্ধ। কোমলমতি শিশু হয়েও যে এই যুদ্ধে শামিল হওয়া যায়; চলমান পিএসসি পরীক্ষায় সেটাই আবার করে দেখালেন সিয়াম, রফিকুল, জেবা, আকাশ আর সৈয়দ নূররা।

দু’পা নেই, তবুও লেখায় স্বাভাবিক গতি

গত বোরবার পিএসসি পরীক্ষায় পা দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে লেখা দেখে বিস্মিত হচ্ছিলেন হলের সকলেই। বিষয়টি এতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরীক্ষার প্রথমদিন অদম্য এই শিক্ষার্থীর পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ও চর্চাশক্তি দেখতে বিদ্যালয়ে ভিড় জমিয়েছিলেন আশেপাশের অনেকেই। ঘটনাটি জামালপুর সরিষাবাড়ী উপজেলার সন্তান সিয়ামের। এলাকার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের জিন্না মিয়া ও জোসনা বেগমের ছেলে সিয়াম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সিয়াম। জন্ম থেকেই তার দুটি হাত নেই। দিনমজুর বাবা-মা’র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সিয়ামের পড়ালেখা। প্রতি মাসে ২৫০ টাকা বেতনও দিতে পারতো না তার পরিবার।

পরে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বেতন মওকুফ করে আবার পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে সিয়ামের। সে এবার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া ব্র্যাক শিশু নিকেতন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এই এলাকার মহেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিতে দেখা যাচ্ছে তাকে।

সিয়ামের মা জোসনা বেগম বললেন, লেখাপড়ার জন্য সিয়ামকে কখনো বলতে হয় না। নিজের ইচ্ছাতেই সবসময় পড়ালেখা করে সে। কিছু কিছু কাজ ছাড়া সব কাজই সে নিজে করে।

বাংলাদেশের পরীক্ষাগুলোতে প্রায়ই প্রতিবন্ধীদের এমন সংগ্রাম দেখা যায়

 

না দেখলে বিশ্বাস হবে না জেবার জীবনযুদ্ধ

দুটি হাতই নেই রাফিয়া আলম জেবার। কী আর করা; বাধ্য হয়েেই পায়ে লেখা শিখেছে সে। কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার ঈদগাহ ইউনিয়নের ভোমরিয়া ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী জেবা। সে এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থী। অদম্য মনোবল, আর হার না মানা এক শিশু সে। যা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

ভোমারিয়া ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাব্বির আহামদ জানান, জেবার পড়া-লেখার প্রতি খুব আগ্রহ। এবারের সরকারি চূড়ান্ত মডেল টেস্ট পরীক্ষায় জেবা পায়ে লিখে জিপিএ ‘এ’ পেয়েছে। উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ বেলাল হোসাইন জানান, প্রতিবন্ধী হিসাবে বিধি মোতাবেক রাফিয়া আলম জেবাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রত্যেক পরীক্ষায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ মিনিট সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়।

বাবার লাশ ফেলে পরীক্ষার হলে গেল নূর

ভোর রাতে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন বাবা। সেই লাশ বাড়িতে রেখে পরীক্ষা দিতে গেল পিএসসি কক্সবাজারের আরেক পরীক্ষার্থী সৈয়দ নূর। টেকনাফ লেঙ্গুরবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পরীক্ষায় অংশ নেয় সে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী সূত্র মতে, সকালে ছেলেটি (সৈয়দ নূর) যখন পরীক্ষার কেন্দ্রে এসে হলের মধ্যে ঢুকে; তখন থেকেই সে কান্নাকাটি করছিল। সে শিক্ষকদের বলে, আজকে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে, বলতেই সে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শিক্ষকসহ সকলেই তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে সফলভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে সে।

খোঁজে পাওয়া তথ্যমতে, সৈয়দ নূর বর্ডার গার্ড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবা ফরিদ আলম। যিনি আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে ‘আলম ডাকাত’ নামেই পরিচিত। তিনি রোববার (১৮ নভেম্বর) ভোর রাতে পুলিশের হাতে আটক হয়ে রাতেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

কলম কামড়িয়ে লিখে স্বপ্ন দেখে রফিক

হার না মানা আরেক পিএসসি পরীক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি হাতই হারাতে হয়েছে এই ছাত্রকে। তবুও থেমে যায়নি রফিকুল। সব বাধা জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে। পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা যায়, দু’পায়ে কলম ধরে মুখ দিয়ে কামড়িয়ে লিখে যাচ্ছে সে। পা হারিয়েও জীবনযুদ্ধে জয়ী রফিকুলের মুখে তখন হাসি। আর থাকবেেই বা না কেন; এছাড়া যে আর কোন পথও খোলা নেই তার সামনে।

শুধু মুখ দিয়ে লেখা নয়, সবই যেন তুচ্ছ রফিকুলে কাছে 

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে রোববার রফিকুল ইসলামকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিতে দেখা যায়। ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে রফিকুল। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।

রফিকুলের বাবা বজলুর রহমান জানান, ‘ছেলের সড়ক দুর্ঘটনার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার কাছে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। পরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পাশের স্কুল-কলেজ থেকে কিছু সহযোগিতা আসে। সাজেদা আলম বিদ্যানিকেতনের চেয়ারম্যান বিশেষ সহযোগিতা করেন। সবার সহযোগিতা ও নিজের জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন ছেলেকে।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীতাকে জয় করেছে আকাশ মালো

চোখে স্বপ্ন, বুকে বল আর অদম্য ইচ্ছা নিয়ে নিয়ে জীবনের প্রথম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে দু’চোখের দৃষ্টি হারানো আরেক প্রতিবন্ধী আকাশ মালো। জয়পুরহাট উপজেলার পাঁচবিবি গ্রামের আদিবাসী সুজিৎ মালোর দু’ছেলের মধ্যে বড় আকাশ। এবার সে দানেজপুর ব্র্যাক স্কুল থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। 

পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আকাশকে প্রশ্নপত্র পড়ে শোনার পর তারই স্কুলের চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী সহকারি হিসাবে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিচ্ছে। স্কুলের শিক্ষিকা জিনাত আরা বললেন, আকাশের বাবা-মা দু’জনই দিনমজুর। ছেলের এমন অবস্থা হওয়ার পরও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে স্কুলে ভর্তি করান তারা। লেখাপড়া শেষ করে আকাশ শিক্ষক হতে চায় বলেন জানান এই শিক্ষিকা।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীতা থামাতে পারেনি শিশু আকাশ মালোকে

 

বাঙালি শিশু-কিশোরদের উজ্জীবিত করতে কবি কুসুমকুমারী দাশ তার ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় বলে গেছেন, ‘হাত, পা সবারই আছে মিছে কেন ভয়’। কিন্তু ওদের শরীরে তো শুধু হাত-পা নয়, চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে গেছে; উজ্জীবিত হবে কী করে? কিন্তু না হয়েও তো উপায় নেই। এ ছাড়া যে কোনো পথও খোলা নেই শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ পার করতে যাওয়া এই কোমলমতিদের সামনে।