আজ মীনা দিবস

কেন মীনা, কেন নয়?

মীনা চরিত্রটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্বকারী
মীনা চরিত্রটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্বকারী

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, মীনা দিবস। মিড ডে মিলের থিম নিয়ে এ বছর ‘মায়ের দেওয়া খাবার খাই, মনের আনন্দে স্কুলে যাই' স্লোগানে পালিত হচ্ছে দিবসটি। ‘মীনা’ মূলত একটি জনপ্রিয় কার্টুনের মেয়ে চরিত্র, যে শুধু নিজে নয়, অন্য মেয়েশিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেও সোচ্চার হয়ে কাজ করে।

কিন্তু কেন এই মীনা কার্টুন? আর কেন-ই বা অন্য কার্টুন নয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশ্লেষকরা বলছেন, কার্টুন শিশুদের মধ্যে অধিক জনপ্রিয়। আর বাংলাদেশে কার্টুন হিসেবে ‘মীনা’ সুনাম অর্জন করেছে। এখনকার অধিকাংশ তরুণ-তরুণীই শৈশবে মীনার কার্টুনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তাদের ভাষ্য, মীনা কার্টুনে গল্পে গল্পে শিক্ষণীয় ও অনেক মূল্যবান কিছু শেখানো হয়। এখানে দেখানো হয়, কীভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মায়া-মমতা, ভালবাসার বাঁধন ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। নারী বিষয়টিকেও গভীরভাবে দেখানো হয় এই কার্টুনে। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য, আজকাল মীনা আর রাজুকে টেলিভিশনের পর্দায় তেমন দেখাই যায় না। হঠাৎ দেখা গেলেও পুরনো পর্বগুলোই বারবার প্রচার করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুমা রুমা মনে করেন, স্যাটেলাইট চ্যানেলের বদৌলতে বর্তমানে এ দেশে অসংখ্য বিদেশি কার্টুন প্রচার করা হচ্ছে। এসব কার্টুন বর্তমানে অনেক শিশুর কাছে প্রিয়ও হয়ে উঠছে। শিশুদের ওপর বিদেশি কার্টুনের প্রভাব কতটুকু তা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা যায়।

সমাজের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বিভেদ ও বৈষম্য দূর করে সমৃদ্ধ জাতি গঠনের বার্তাসমূহ বিনোদনমূলক কার্টুন চরিত্র মীনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়

কেন মীনা কার্টুন নয়, এমন প্রশ্নের ব্যাখ্যায় রুমার ভাষ্য, প্রথমত, বিদেশি কার্টুনগুলো ভিনদেশি সংস্কৃতির ধারক। শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয় এবং শৈশবে তার মন ও মস্তিষ্ক অনেক বেশি কোমল থাকে, তাই বিদেশি সংস্কৃতিকে শৈশব থেকেই তারা নিজেদের সংস্কৃতি বলে অন্তরে লালন করতে শুরু করে। কার্টুনে দেখানো কথাবার্তা, চিন্তাচেতনা, পোশাক-পরিচ্ছদ—সমস্ত কিছুর প্রভাব পড়ে শিশুদের মানসিক বিকাশে। এই শিশুরা যখন বড় হয়ে নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠবে, তখন নিজ সংস্কৃতি মেনে নিতে তারা অনেকটাই কুণ্ঠাবোধ করবে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগবে। কিংবা বলা যায়, দেশীয় সংস্কৃতিকে তারা যতই অন্তরে লালন করতে চেষ্টা করুক না কেন, শৈশব থেকে শিখে আসা বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকেই যাবে। ফলে পরবর্তী জীবনে বিষয়গুলো বিপত্তির কারণ হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কার্টুনগুলোতে অনেক মিথ্যা কথা, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত বিষয় তুলে ধরা হয়—যা শিশুদের মাঝে ধীরে ধীরে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। অনেক শিশুকেই আমি বলতে শুনেছি—মিথ্যা বলা দোষের কিছু না। কারণ কার্টুনে সে মিথ্যা বলতে শুনেছে, কেউ তাকে বকে না। সুতরাং শিশুরা মিথ্যা বলাকে সহজ বলে মেনে নিতে শেখে ও তার একটি অঘোষিত স্বীকৃতি পেয়ে যায়। শিশুদের মানসিক বিকাশে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক। কার্টুন দেখার সময়টুকু শিশুদের জন্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন সেখানে ভালো গল্প, কাহিনি, শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হবে। কিন্তু আজকাল এমন অনেক বিদেশি কার্টুন প্রচার করা হয়, যেখানে নীতিশিক্ষার দেখা মেলে না।

জানা যায়, ১৯৯১ সালে একজন ১০ বছর বয়সী বালিকা হিসেবে মীনা চরিত্রের সৃষ্টি। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বিভেদ ও বৈষম্য দূর করে সমৃদ্ধ জাতি গঠনের বার্তাসমূহ বিনোদনমূলক কার্টুন চরিত্র মীনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। মীনা চরিত্রটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বালিকা চরিত্র। এরই মধ্যে অনেক বিষয়ে মীনা কার্টুন পর্ব ও মীনা বই তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চরিত্রটি শিশু ছাড়াও সব বয়সের মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে।

বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে মীনা কার্টুন দেখানো শুরু হয়

মীনার উল্লেখযোগ্য কার্টুনগুলো হলো: ‘মুরগিগুলো গুণে রাখ’, ‘বুদ্ধিমতী মীনা’, ‘মীনা এল শহরে’, ‘মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে’, ‘জীবন বাঁচানো’, ‘মীনার তিনটি ইচ্ছে’, ‘যৌতুক বন্ধ করো’, ‘বিয়ের বয়স হয়নি’, ‘মীনা ও দুষ্টু ছেলেরা’, ‘মেয়েদের যত্ন নাও’, ‘জাদুর পাথর’, ‘মীনার বন্ধু অনু’, ‘নতুন বন্ধু পিনুই’, ‘রূপকথার দেশে মীনা’, ‘পরীর গল্প’ ও ‘মীনার যুদ্ধ’।

জানা যায়, ইউনিসেফ বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের নিয়ে বা শিশুদের জন্য নির্মিত বিনোদনমূলক, সংবাদভিত্তিক ও জীবনধর্মী প্রতিবেদন, প্রকাশনা ও অনুষ্ঠানের জন্য মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছে। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় নগদ টাকা, ক্রেস্ট ও সনদ। প্রথম পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ২৫ হাজার টাকা ও তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। মীনাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে পালাগান, বাউলগান, মীনার পাপেট শো, রেডিও জিঙ্গেল, গান, নাটিকা প্রভৃতি। মীনার ছবি-সংবলিত টি-শার্ট, মগ, বাসন, শুভেচ্ছা কার্ড, মীনা ও মিঠুর পুতুল, স্টিকার প্রভৃতি বানানো হয়।

মীনাকে ভালবেসে এমন অসংখ্য গ্রুপ তৈরি হয়েছে ফেসবুকে

১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান তাদের ফ্লাইটের অভ্যন্তরীণ বিনোদন কর্মসূচিতে মীনা কার্টুন অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিটি ফ্লাইটে মীনা কার্টুন প্রদর্শিত হতো। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে মীনা। বিভাগীয় শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মীনার ১১টি দেয়ালচিত্র। ঢাকা শহরের বহু রিকশামালিক তাঁদের রিকশার পেছনে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের বদলে মীনার ছবি এঁকেছেন

ইউনিসেফ সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মীনা কার্টুন শুধু বাংলা ভাষায় তৈরি হয়নি। হিন্দি, উর্দুসহ ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। প্রথমে মীনার ১৩টি পর্ব বানানো হয়েছিল। প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। এখন মীনার ২৭টি পর্ব রয়েছে। মীনার কার্টুন ছবি নিয়ে ২৩টি কমিক বইও বের হয়েছে। এসব বইও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের ওপর টেলিভিশন ও বেতারের জন্য স্পট তৈরি করা হয়। এতেই বোঝা যায়, মীনা কতটা জনপ্রিয়।

১৯৯৮ সাল থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী মীনা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ