এক জেলায় ১৩১৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৮৮টিতেই নেই প্রধান শিক্ষক
ময়মনসিংহ বিভাগের অন্যতম হাওর পরিবেষ্টিত জেলা নেত্রকোনা। জেলাটি পশ্চাতপদ জেলা হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাজ করছে নাজুক অবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় জেলার ৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে দুর্গম এলাকাগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক।
জেলায় সবমিলিয়ে ১৩১৩টি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৮৮টিতে প্রধান শিক্ষকের পদই শূন্য রয়েছে এবং সহকারী শিক্ষকও নেই ২৩০টিতে। ফলে প্রধান শিক্ষকের সকল কাজ করতে হয় সহকারী শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্তদের। যার কারণে বাড়তি চাপে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। সেই সঙ্গে ব্যাহত হয় পাঠদানও।
শুধু শিক্ষকের ঘাটতি নয় এর বাইরেও জেলার সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ৪৬ পদের মধ্যে ২২ টি পদ শূন্য রয়েছে। একজনকে কয়েকজনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এছাড়াও ১০ উপজেলার ১০ জন হিসাব সহকারীর মাঝে রয়েছে মাত্র ২ জন। অফিস সহায়ক ১০ জনের মধ্যে ৭টি শূন্য পদ। উচ্চমান সহকারী পদে ১০ জনের মধ্যে ৬টি পদই শূন্য। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ১৮ টি পদের মধ্যে ৫ টি শূন্য। এমনি করে জনবল সঙ্কটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
এদিকে, জেলার উপজেলাগুলোর ইউনিয়ন পর্যায়ে সৃষ্ট পদ শূন্য থাকলেও পৌর এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায়, ৫ থেকে ৬ জনের স্থলে ৯ জন থেকে ১৩ জন করে জনবল রয়েছে। চাকরির সুবাদে লবিংসহ নানা ধরনের তদবির করে গ্রাম থেকে শিক্ষকরা চলে আসেন শহরের নিজ বাড়ি ঘরের আশপাশে। তাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি বলে জানা গেছে স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে।
সুশীল সমাজের নেতারা বলছেন সকলেই বদলি হয়ে আরাম করতে শহরে পাড়ি জমায়। তা না হলে গ্রামগুলোতে প্রধান শিক্ষক সংকট থাকলেও সহকারীদের দ্বারা পাঠদানে সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। তারা সমন্বয় করে মিলিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু পৌরসভার ২৫টি স্কুলের বেশিরভাগেই রয়েছে অতিরিক্ত শিক্ষক।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের স্কুলে ব্যয় বাড়ছেই, নীতিমালা না থাকাকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা
যেমন শহরের মালনি এলাকায় চন্দ্রনাথ স্কুলে ১৩ জন ও হোসেনপুর স্কুলে ৯ জন শিক্ষক রয়েছে। ৬ থেকে ৭ জনের স্থলে এত শিক্ষক কেন রয়েছে তার জবাব দিতে পারেননি কেউ। উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদালয়েও একই অবস্থা।
অথচ কিন্ডারগার্টেন বেশি থাকায় শহরের প্রতিটি প্রাথমিকে শিক্ষার্থী একেবারেই কম। যারা রয়েছে তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিক্ষক সংকটে থাকা এসব স্কুলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনে ও পাঠদানে বেশ চাপে থাকতে হয়।
এদিকে গ্রামের স্কুলগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক না থাকায় শহরের গ্রামের সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা যার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ শিক্ষা পাচ্ছে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
সুজনের সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল জানান, শিক্ষকরা চাকরির পরপরই চেষ্টা করে কীভাবে শহরে চলে আসবে। গ্রামে চাকরি হলেও নানা লবিং করে তাদের পছন্দসই জায়গায় চলে আসাটা একটা সমস্যা। ফলে ওই এলাকায় শিক্ষকের ঘাটতি তৈরি হয়। চাইলেই সেখানে কাউকে দেয়া যায় না। তাছাড়া শিক্ষকরা আজকাল রাজনীতিসহ বিভিন্ন কিছুর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়া এই সমস্যার আরেকটি কারণ। শিক্ষক সমিতির মধ্যেও রয়েছে গ্রুপিং। ফলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করে না কেউ। সবাই নিজেদের সুবিধা নিয়ে আছে।
এসব সংকটের কথা স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শিক্ষক নেতারা বলছেন এ সমস্যাগুলো নিরসনে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি শাহনাজ পারভীন বলেন, শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই। যারা মনিটরিং করবে সেই সমস্ত কর্মকর্তাও নেই। আমি গত ১২ বছরে জেলার সদরের ৭টি পোস্টের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনের বেশি দেখিনি।
সরকারী উপজলা শিক্ষা কর্মকর্তা জিয়াউল হক জানান, কিছুটা সমস্যা হলেও আমরা প্রতিনিয়ত ক্লাস্টার ডিউটিগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করি। ৭ জনের জায়গায় ৩ জন কাজ করলে কিছুটা ঘাটতি তো থাকবেই। তারপরেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।
এদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান সংকটের বিষয়গুলো স্বীকার করে জানান, প্রধানত মামলা সংক্রান্ত কারণে এই সংকট। তবে এই সংকট নিরসনে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সমস্যা বেশি দিন থাকবে না। সামনের নিয়োগে হয়ত অনেকগুলো পদ পূরণ করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত অবসরে যাওয়াও শূন্যতার একটি কারণ। তারপরও তারা শিক্ষক শূন্যতার এই সংকটকে পাশ কাটিয়ে এবার বছরের প্রথমেই বই দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের হাতে। অন্যান্য সমস্যাগুলোও কাটিয়ে উঠবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক আবু জাহিদ দুলদুলের সাথে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।