‘দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা দরকার’
দেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় বাজেট ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্যোগকালে ও পরবর্তীতে করণীয় সম্পর্কে প্রস্তুতির অভাব, তদারকির অভাব প্রভৃতি সমস্যা রয়েছে। সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। নতুন শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান, বিদ্যালয় অবকাঠামোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দুর্যোগ-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ দুটি জেলা খুলনা ও বাগেরহাট জেলার ৪টি উপজেলায় পরিচালিত ‘বাংলাদেশে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদান, শিখন এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ঘাটতি’ শীর্ষক গবেষণার প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত ‘শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে জাতীয় নীতি সংলাপে’ এসব কথা বলেন বক্তারা। সংলাপ সঞ্চালনা এবং এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা কর্মসূচির উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা।
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আসে শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় গুণগত শিক্ষায় আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। ওয়েভ ফাউন্ডেশন এডুকেশন আউট-লাউড প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন: একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশ্বিক গুণ-মান অর্জন
তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ ৭টি পক্ষ রয়েছে। এই পক্ষগুলোর সমন্বয়ের দুর্বলতা গুণগত মান অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গুণগত মান অর্জনে পিছিয়ে থাকায় আমরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও যোগ্য মানুষকে সবসময় খুঁজে পাই না। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকদেরকে দুর্যোগকালে ও পরবর্তীতে শিক্ষার ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে হবে বলেও জানান তিনি।
সংলাপে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ, জলবায়ু অভিঘাত, উষ্ণায়ন, শিক্ষা দারিদ্র্য এসব দুর্যোগ আমাদের একত্রিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের তথ্যগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের গবেষণা বিষয়ে আরো গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে এই প্রক্রিয়ার সাথে।
শিক্ষকদের সক্ষমতা ও শিক্ষা ব্যয় বাড়ানো, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শ্রেণি রুটিন ইত্যাদির সন্নিবেশন শিক্ষার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষা পাঠ্যক্রম যদি বাস্তবসম্মত না হয় তবে মানসম্মত শিক্ষার প্রাপ্তিটা অপ্রাপ্তিই রয়ে যাবে—জানান ড. মনজুর আহমেদ।
আরও পড়ুন: কোচিং ও গাইড বইয়ে বছরে খরচ ৩০ হাজার টাকা: গবেষণা
দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে খুলনা ও বাগেরহাটের ৪টি উপজেলায় পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে শাহজাদা এম আকরাম উল্লেখ করেন, গত কয়েক দশকে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটলেও শিক্ষার মান এখনো একটি চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, কাঠামোগত পরিবর্তন, শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন এবং শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নসহ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর বেশকিছু মূলনীতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার যে সমস্যাগুলি গবেষণায় উঠে এসেছে সেগুলো হলো: পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব; বক্তৃতাভিত্তিক পাঠদান প্রক্রিয়া; গতানুগতিক পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন; দুর্বল ও অনিয়মিত তদারকি; দুর্যোগের কারণে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এসময় আলোচনায় সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (কার্যক্রম) ও যুগ্মসচিব মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, সরকার বৃত্তি, উপবৃত্তি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এছাড়া মনো-সামাজিক অবস্থা, প্রযুক্তি, ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা একটা প্রতিবন্ধী ডেটাবেস তৈরি করেছি যেখানে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের তথ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। সকলের সমন্বিত ইতিবাচক ভূমিকার মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আরও পড়ুন: ভাগ অংশের সমাধান পারে না প্রাথমিকের ৯৫% শিশু
সংলাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের সুসম্পর্ক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। গবেষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাতে ভারসাম্য, শিখন পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, নতুন পাঠ্যক্রম ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা গেছে। আমাদের গুণগত শিক্ষা অর্জন করতে হলে বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো সিবান শাহানা বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণগুলো এবং কোথায় আমাদের ঘাটতি আছে এটা বের করে সমতা এবং সাম্যের ভিত্তিতে একটি লক্ষ্য ঠিক করে আমাদের সমস্যা সমাধানের পথে যেতে হবে। এছাড়াও সংলাপে ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ বলেন, গবেষণায় কেস স্টাডি আরো বেশি করে নিয়ে আসলে, প্রত্যাশাগুলোর বাস্তবতা আরও দৃঢ় হতো।
সংলাপে স্ট্রিট চাইল্ড ইউকে’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ হৃদয় প্রকল্পের সার্বিক দিক তুলে ধরতে গিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। এ সময় তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মোকাবেলা এবং প্রস্তুতি বাড়ানোর দিকে আরো গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন।