প্রাথমিকের নিয়োগে ৮০ শতাংশই কোটা, ভালো করেও বাদ পড়ছেন অনেকে
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বিতর্কের যেন অবসান নেই। ২০১৮ সালের পর এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের ফলাফল। এই নিয়োগে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৮০ শতাংশ কোটা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী কোটা ও ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা।
জানা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে। কোটা পদ্ধতির হার বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে আছে—নারী ৬০%, পুরুষ ২০% ও পোষ্য ২০%। এ ছাড়া বিজ্ঞান শাখায় ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষক ২০% নিয়োগের কথা বলা আছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস)-২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৬ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন তিন লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে নারী শিক্ষকরে সংখ্যা দুই লাখ ৩১ হাজার ২৮৬ জন। আর পুরুষ শিক্ষককের সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ৮০৭ জন। অর্থ্যাৎ, নারী শিক্ষকের হার ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
আরও পড়ুন: প্রাথমিকে বড় নিয়োগ আসছে
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী শিক্ষক থাকার পরও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষণে ক্ষুব্ধ চাকরি প্রত্যাশীরা। তারা বলছেন, ৬০ শতাংশ নারী কোটা ও ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা সংরক্ষণ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবি শিক্ষকদের প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ৮০ শতাংশ কোটার কারণে সাধারণ চাকরি প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় অনেক ভালো করার পরও বাদ পড়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কোটার কল্যাণে অনেকেই কোনোমতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। এতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা কাঙ্খিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সব নিয়োগে কোটা বাতিল হওয়া শর্তেও সরকারি নিয়োগ বিধি এবং সংবিধানে বর্ণিত নিয়োগের নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়োগ বিধি-২০১৯-এ বিশেষ বিধান নামে একটি বিধান যুক্ত করে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি নয়, এমন গোষ্ঠীকে সিংহভাগ কোটা প্রদান করে নিয়োগের নিমিত্তে একটি তালিকা প্রদান করেছে। ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা, ২০ শতাংশ পুরুষ কোটা প্রয়োগ করা হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে ৩৭ হাজার ৫৭৪টি পদের নিয়োগে খুব অল্পসংখ্যক পুরুষ নিয়োগ পেয়েছেন।
তারা বলছেন, কোনো শ্রেণিকে ঠকিয়ে অন্য শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার এখতিয়ার সংবিধান কাউকে দেয়নি। যেহেতু রাষ্ট্র বেকার ভাতার মতো কোনো কর্মসূচি হাতে নিতে পারছে না, তাই প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক, রেলওয়েসহ অন্যান্য সেক্টরে যতটুকু নিয়োগের সুযোগ আছে, তাতে প্রতিবন্ধীদের মতো অনগ্রসর শ্রেণির কোটা রেখে বাকি সব কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
জানা যায়, চাকরিপ্রত্যাশী মো. তারেক রহমানের পক্ষে আইনজীবী একলাস উদ্দিন ভূঁইয়া আদালতে একটি রিটপিটিশন করলে, আদালত রুল জারি করেন কোটা বাতিলের পক্ষে। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। রুল জারি করা হলেও গত এক বছরে কোনো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি ওই রুলের প্রেক্ষিতে।
আরও পড়ুন : প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে নতুন কোটা চালুর দাবি
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘অধিকার বঞ্চিত বেকার সমাজ’-এর ব্যানারে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগে কোটা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছে চাকরি প্রত্যাশীরা। তারা সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাথমিকের ফলাফলকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা বাতিল করা, কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং শিক্ষক নিয়োগে বিদ্যমান নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে দ্রুত সম্পন্ন করে নতুন কোটামুক্ত পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার দাবি জানান।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, প্রাথমিকসহ কোনো স্তরেই শিক্ষক নিয়োগে কোটা থাকা উচিৎ নয়। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য কিছু কোটা সংরক্ষণ করা যেতে পারে, তবে তার পরিমাণ বিদ্যমান ৬০ শতাংশের কম হওয়া বাঞ্চনীয়। আবার অনেকেই প্রাথমিকে নারী কোটা চাইলেও পোষ্য কোটাকে অপ্রাসঙ্গিক বলছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু পেশা আছে যেগুলোতে নারীরা ভালো করে থাকেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা তেমনি একটি পেশা। এখানে অধিক নারীকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা উচিৎ নয়, কারণ নারীরা ছোট বাচ্চদের ভালো বুঝতে পারেন। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যদেরকেই বাছাই করতে হবে। যারা শিক্ষক হবে তাদের মান যেন মন্দ না হয়। তবে, এ পেশায় মেধাবিদের যোগদান নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
পোষ্য কোটার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কোনো চাকরিতেই পোষ্য কোটা থাকা উচিৎ নয়। এ ব্যাপারে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলো চিন্তা করতে পারে।