গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা

প্রাথমিকে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের ভিত মজবুদ হবে

গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা
গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা

চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে শতভাগ সৃজনশীল বা যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নে পরীক্ষা নেবে সরকার। এরই ফলে শিক্ষার্থীদের ভিত আরও মজবুদ হবে। তারা মুখস্থবিদ্যা পরিহারের পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা যথাযথ প্রশিক্ষিত না হলে শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হতে পারে।

রবিবার রাজধানীর তেজগাঁওস্থ আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে ‘প্রাথমিক শিক্ষায় যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন’ র্শীষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ এবং ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (ইউনিক-২ প্রকল্প) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমীর (নেপ) মহাপরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভালো একটি শিক্ষাক্রম করেছে কিন্তু মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। যদিও নেপ ২০১২ সাল থেকে প্রাথমিকে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু করলেও সেটি লিখিত পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গঠনমূলক মূল্যায়ন না থাকায় সেটির সমস্যা হতো, তবে সম্প্রতি এনসিটিবি এ উদ্যোগটা নিয়েছে যাতে করে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা কাটবে বলে মনে করি।

তিনি বলেন, আমাদের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বাচ্চাদের শিক্ষার্থী না বানিয়ে পরীক্ষার্থী বানানো। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তারা জিপিএ-৫ আশা করে, কিন্তু সমাপনী শেষে কি শিখতে পারছে-তারা সেটা মূল্যায়ন করে না।
মো. শাহ আলম বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করে নেপ। ১০ শতাংশ দিয়ে ২০১২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু করে নেপ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে সেটি ৮০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে এ বছর সেটি শতভাগ হবে। আর বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বাদ দেয়া হবে। এর আগে জাতীয় কর্মশালার ভিত্তিতে আমরা একটি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছি, পরে অবশ্যই সেটি পরিমার্জিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বাচ্চাদের সঠিক এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। যাতে তারা আগামীদিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে। এটা সরকারের একটি বড় প্রতিশ্রতি তাই এখানে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাছাড়া সরকারের সবচেয়ে বড় সেক্টর প্রাথমিক শিক্ষা; এখানে সরকারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগও করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন কাজ করছে নেপ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন। নেপে একটি প্রশিক্ষণের আয়োজনও করে মিশন। বিষয়টি আমরাও খুবই গুরুত্ব নিয়েছি। আজকের বৈঠকে যে আলোচনা হবে এবং সুপারিশ করা হবে-আগামীতে এসব বিবেচনায় করবে নেপ। দেশে অনেক বেসরকারি সংস্থা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। তবে আজকের এ ধরণের উদ্যোগ আগে কাউকে নিতে দেখিনি। এজন্য ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনকে ধন্যবাদ জানায়।

প্রাথমিক শিক্ষায় যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের অভিজ্ঞতা উপস্থাপনকালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (ইউনিক-২ প্রকল্প) এর বেসিক এডুকেশন কোঅর্ডিনেটর ছালেহা আক্তার বলেন, ২০১২ সাল থেকে মিশন যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্বতি বাস্তবায়ন করে আসছে। শোনা, বলা, পড়া ও লেখা-এ ৪টি দক্ষতাকেই মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে। এটি এনসিটিবির নির্ধারিত যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।

সূচনা বক্তব্যে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক ড. এম. এহছানুর রহমান বলেন, চলতি বছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) বাদ দিয়ে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে। এজন্য চলতি বছরের এপ্রিলে একটি পরিপত্র জারি করেছে নেপ। ২০১২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু করেছে নেপ। এরপর থেকে ধাপে ধাপে ২০১৮ সালে সেটি শতভাগ হয়।

তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (ইউনিক-২ প্রকল্প) যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যয়নটি করে যাচ্ছে। এ পরিপত্র জারি হওয়ার পর একটি আমরা ভালো সুযোগ বলে মনে করি। আজকের এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারবো। এটি জাতীয়ভাবেও একটি কন্ট্রিবিউশন হবে।

ড. এম. এহছানুর রহমান বলেন, আমরা নেপ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। তাদের সঙ্গে কর্মশালা করেছি, অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করেছি। এরকম পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমরা আজ একটি জায়গায় এসে একত্রিত হয়েছি। এখানে উপস্থিতিদের আলোচনার ভিত্তিতে আগামী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে প্রশ্নপত্র কাঠামো প্রণয়ন এবং শিক্ষার্থীদেরও যথাযথ মূল্যায়ন হবে বলে মনে করি।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইস্টিটিউটের অধ্যাপক এম. নাজমুল হক বলেন, স্কুলগুলোকে দ্বায়িত্ব দিতে হবে যাতে তারা শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়নের সুযোগ পায়। এজন্য শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর স্কুলের জন্য এবং বাকি শতকরা ৫০ ভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্কুল ও কেন্দ্রীয় দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল উত্তীর্ণ হতে পারবে। আমাদের যে অর্জনীয় ২৯টি যোগ্যতা আছে সেগুলো যথাযথ ভাবে অর্জনের জন্য ছাত্র শিক্ষকের যে অনুপাত তা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ শফিকুল আলম বলেন, আমাদের এখনকার যে পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা তাতে আমরা আসলে শিক্ষার্থী নয় বরং পরীক্ষার্থী সৃষ্টি করছি। ফলে চলমান মূল্যায়নে কোনো ধরনের মূল্যায়ন হচ্ছে না। পাঠ্য বইগুলোর প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঠ্যবইগুলো দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের বইগুলো অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু বইগুলোতে সঠিক বানান ঠিক করা হয়নি, কিছু কবিতাতেও নেই সঠিক যতিচিহ্ন। এছাড়া আমরা পাঠ্য বইয়ে শিখনফল যুক্ত করে দিয়েছি কিন্তু যারা এসব পাঠদান করেন কিংবা মূল্যায়ন করবেন তারা এসব বিষয়ে জানেন কিনা এটা নিশ্চিত করতে হবে। এনসিটিবি’র কাজ হচ্ছে উন্নত পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষা উপকরণ প্রণয়ন করা কিন্তু যারা এসব পড়াবেন বা মূল্যায়ন করবেন তাদেরকেও উন্নত মানের হতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরী।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক ড. এম. এহছানুর রহমানের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় আরও অংশ নেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রধান মুর্শিদা আক্তার, ব্রাকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যবই) অধ্যাপক ড. মিয়া এনামুল হক সিদ্দিক, ঢাকাস্থ ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম অফিসার শিরিন আক্তার, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের ডিরেক্টর অব প্রোগ্রাম ড. খাজা শামশুল হুদা প্রমুখ। এছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (ইউনিক-২) এর প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফারুক হামিম।


সর্বশেষ সংবাদ