করোনা মোকাবিলায় কেন নারী নেতৃত্বাধীন দেশগুলো সফল?
চীনের উহান থেকে ইউরোপ হয়ে করোনা ভাইরাস এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের প্রায় দু’শতাধিক দেশে হানা দিয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটি। এরমধ্যে যেসব করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ কে প্রতিরোধ করতে দৃশ্যত সফল হয়েছেন তাদের প্রথমসারিতে রয়েছেন নারী নেতৃত্ব। অন্যান্য দেশের তুলনা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। এই তালিকায় রয়েছে আইসল্যান্ড থেকে শুরু করে তাইওয়ান, জার্মানি আর নিউজিল্যান্ড, সর্বত্রই নারীর জয় জয়কার। নারীরাই বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে কীভাবে করোনাভাইরাসের মতো জটিল বিষয় সামাল দিতে হয়।
এছাড়া ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও ডেনমার্কেও একই কাহিনী। অনেকে অবশ্য বলবেন যে, এসব দেশগুলো ছোট দেশ, বা দ্বীপরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ব্যতিক্রমের কথা টানবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জার্মানি অনেক বড় দেশ। দেশটি করোনা মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। করোনায় সফল নারী প্রধানদের নিয়ে ফোর্বস ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটে একটি সফলতার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে উঠে আসে নারী নেতৃত্বদের সফল গল্পগুলো। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের কথাই ধরুন। তিনি সংকটের শুরুতেই সোজাসাপ্টাভাবে মানুষকে বলেছেন, এই রোগ অত্যন্ত ভয়াবহ। দেশের ৭০ শতাংশ নাগরিক এতে আক্রান্ত হতে পারে। তিনি বলেন, “এটি অত্যন্ত গুরুতর। একে গুরুত্বের সঙ্গে নিন।” কোনো ধানাইপানাই বা রাখঢাক রাখেননি। তিনি নিজে একে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। নাগরিকরাও তার কথা শুনেছেন। অন্যান্য দেশে যেমন, অস্পষ্টতা ও হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করা বা আড়াল করার প্রবণতা দেখা গেছে, তেমনটি জার্মানিতে দেখা যায়নি। দেশটি সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার হার বাড়িয়েছে। অনেক বড় দেশ হলেও দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক অনেক কম। এমনকি অন্যান্য দেশের তুলনায় জার্মানি আগেভাগেই চলাচলের ওপর কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ লঘু করতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সবার আগে সবচেয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দেশগুলোর একটি হলো তাইওয়ান। জানুয়ারিতে যখন এই নতুন রোগের উপসর্গ দেখা দিতে লাগলো, দেশটির নেত্রী সাই ইং-ওয়েন রোগের বিস্তার প্রতিরোধে ১২৪টি পদক্ষেপ নিলেন। এর মধ্যে লকডাউন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ, অন্যান্য দেশকে অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে শেষ পর্যন্ত লকডাউনের আশ্রয় নিতে হয়েছে। তার দেশের অবস্থা এতই ভালো যে তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ১ কোটি মাস্ক পাঠাচ্ছেন। সিএনএন’র মতে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাইওয়ান। দেশটিতে এই মহামারী একেবারেই নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে। মারা গেছেন মাত্র ৬ জন রোগী।
নিউজিল্যান্ডে জ্যাসিন্ডা আর্ডের্ন খুব দ্রুতই লকডাউন ঘোষণা করেন। তিনি এই বিষয়ে স্পষ্ট ছিলেন যে, দেশকে সর্বোচ্চ মাত্রার সতর্কতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কেন এই ব্যবস্থা তা-ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন তিনি। দেশে যখন মাত্র ৬ জন রোগী ধরা পড়ে, তখনই তিনি নিউজিল্যান্ডে প্রবেশকারী ব্যক্তিদের সেলফ-আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করেন। শিগগিরই তিনি দেশে বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। স্পষ্টতা ও ত্বরিতগতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারায় আজ নিউজিল্যান্ড অনেকটাই সুরক্ষিত। মধ্য এপ্রিল নাগাদ, নিউজিল্যান্ডে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৪ জন।
প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকবসদত্তিরের নেতৃত্বে আইসল্যান্ড দেশের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কভিড-১৯ রোগের বিস্তার নিয়ে দেশটি হয়ে উঠবে এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাস্থল। দক্ষিণ কোরিয়াকে পরীক্ষার দিক দিয়ে অনেকেই অনুকরণীয় ভাবেন। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে আইসল্যান্ড দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও ৫ গুণ বেশি পরীক্ষা করিয়েছে। দেশটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ট্রাকিং সিস্টেম চালু করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে দেশটিতে লকডাউন আরোপ করতে হয়নি। এমনকি স্কুলও বন্ধ করা হয়নি।
ফিনল্যান্ড সানা ম্যারিন যখন রাষ্ট্রপ্রধান হন ডিসেম্বরে, তখন তিনি ছিলেন বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপ্রধান। মিলেনিয়াল যুগের এই নেতা করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। তিনি বুঝতে পারেন যে, সবাই পত্রপত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম দেখে না। ফলে তথ্যভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন।
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সলবার্গও কম সৃজনশীল নন। তিনি টেলিভিশন ব্যবহার করে সরাসরি দেশের শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ৩ মিনিটের প্রেস কনফারেন্স করার মডেল ব্যবহার করেন তিনি। তার আগে ডেনমার্কের নারী প্রধানমন্ত্রী মেত্তে ফ্রেডেরিকসেনও একই মডেল ব্যবহার করেন। সলবার্গ আবার আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না। শুধু শিশুরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সারাদেশের শিশুদের প্রশ্ন শোনেন ও সময় নিয়ে জবাব দেন।’