ঢাবি ছাত্র খোকা যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে
নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। ক’দিন ধরেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার পর আজ বেলা ১টায় মারা যান তিনি।
সাদেক হোসেন খোকার জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ মে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।
ছাত্রজীবনে ১৯৬৮ সালে বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে খোকার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। ৬৯ এর গণঅভ্যুথান- ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে মনোনীত হয়ে ঢাকা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। এর পর ৯০ এর স্বৈরাচার এরশাদ পতন আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন খোকা।
১৯৮৭ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাত ধরে এ রাজনীতিতে আসেন তিনি। অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই মেয়াদে সভাপতি ছিলেন খোকা।
বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে শুরু হয়েছিল সাদেক হোসেন খোকার রাজনৈতিক জীবন। তবে বামপন্থী রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে বিএনপিতে যোগ দেন খোকা। তার সবচেয়ে কৃতিত্ব আজও মনে রেখেছে পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়। সময়টা ১৯৯০ সাল। সেই সময় ভারতে কয়েকশ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে দেন কট্টরপন্থী হিন্দুরা।
এতে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু হয়। সেই রেশ এসে কিছু পড়ে বাংলাদেশেও। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ভাঙা কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা ঘটে।
কিন্তু সেবা সময় সেই দাঙ্গা রুখে দেন সাদেক হোসেন খোকার প্রতিরোধ ও দৃঢ় নেতৃত্ব। তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে পুরান ঢাকায় ভারতের সেই ঘটনার আঁচ তেমন একটা পড়েনি। এমন ভূমিকা নিয়ে পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেন খোকা। তাদের হৃদয়ে স্থান করে নেন তিনি এবং একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন।
সেই জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে। খোকা ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থীর ভরাডুবি হয়। কিন্তু একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন। তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। সেই সময় মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।
২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। সেই সময় তাকে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।
ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা।
পড়ুন: প্রেস রিলিজে সরব, বাস্তবে নিরব জয়-লেখক!
বিএনপির এ নেতা ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের ১৪ মে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক যান। তারপর থেকে সেখানেই রয়েছেন তিনি। চলতি বছরের গত ১৮ অক্টোবর খোকার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সবশেষ ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কে ম্যানহাটনের স্লোন ক্যাটরিং ক্যানসার সেন্টার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সাদেক হোসেন খোকা দীর্ঘদিন ধরে কিডনির ক্যানসারে ভুগছিলেন।
২০১৭ সালের শেষদিকে তার এবং স্ত্রী ইসমত হোসেনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘদিনেও তাদেরকে পাসপোর্ট না দেওয়ায় এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে খোকা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন।
ছয় মাস আগে ইসমত হোসেন সশরীরে কনস্যুলেটে গিয়ে পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা প্রথম সচিব শামীম হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। তার কাছ থেকে পাসপোর্টের বিষয়ে কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
দীর্ঘদিন চিকিৎসার মধ্যে থাকার পর গত কয়েক মাস ধরে সাদেক হোসেন খোকা দেশে ফেরার জন্য বার বার আকুতি প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি বলতেন, ঢাকায় যাওয়ার পর জেলে যেতে হলে যাবো, চিকিৎসার জন্য আর আসতে না দিলেও সমস্যা নাই। দেশে গিয়েই মরবো।
সাদেক হোসেন খোকার ফুসফুসে ক্যানসার মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। কিডনি ক্যানসারের চিকিৎসা নেওয়ার সময় হঠাৎ করেই ফুসফুস আক্রান্ত হলে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। তিনি প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।
গত সাড়ে পাঁচ বছর যাবৎ ছিলেন নিউইয়র্ক সিটির ইস্ট এলমহার্স্ট এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।
উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার চেষ্টা করলে ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের বাধায় প্রথম দফা তিনি ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের আদেশে তার বিদেশ গমনে বাধা দূর হলে প্রায় তিন সপ্তাহ পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
ওই তিন সপ্তাহ দেরি হওয়ার কারণেও ক্যানসার তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে বলে জানানো হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। তারপরও নিউইয়র্কে চিকিৎসা শুরুর পর গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তার ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিলো।