পাসপোর্টের অভাবে খোকার লাশও আসবে না দেশে?
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানের ক্যানসার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। চিকিৎসকরা তাঁর বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।
আর এরই মধ্যে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে মৃত্যুর পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিকের শেষ ইচ্ছা পূরণ নিয়ে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট না থাকায় তাঁর মরদেহ দেশে পাঠানো যাবে কি না এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় খোকার পরিবার। একই পরিস্থিতির কারণে সাদেক হোসেন খোকার স্ত্রীও যেতে পারবেন না দেশে।
তার পরিবার বলছে সাদেক হোসেন খোকা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেন দেশে যাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে। যে দেশের মাটির জন্য তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন সেই মাটিতেও হয়তো চিরনিন্দ্রায় শায়িত হতে পারবেন না ঢাকাবাসীর এক সময়ের প্রিয় মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তাই হাসপাতালের লবিতে দাঁড়িয়ে অনেকেই চোখের জল বিসর্জন করে বলছেন, একজন ভালো মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সকালটি মনে হচ্ছে ‘রাতের চেয়েও অন্ধকার’।
এমন চিন্তা করেই সাদেক হোসেন খোকার রাজনীতির সতীর্থ ও নেতাকর্মীরা বলছেন, যে ব্যক্তি দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ থেকে তিনি দেশান্তরিত হয়ে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী।
সাবেক এই মন্ত্রীর সুস্থ হয়ে ওঠার আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায় চিকিৎসকরা এরই মধ্যে তার ক্যানসার চিকিৎসায় ক্ষান্ত দিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্লোন কেটেরিং ক্যানসার সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে সাদেক হোসেন খোকাকে।
খোকার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ও চিকিৎসার তত্বাবধানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মিজানুর রহমান ভূইয়া মিল্টন বলেন, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের মে মাসে একজন ভিজিটর হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র।
নিউইয়র্কের স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর পর প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে চিকিৎসকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। সে কারণে লম্বা সময়ের জন্য নিউইয়র্ক ছেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না তাঁর। কিন্তু ভিজিটর ভিসার নিয়মানুযায়ী প্রতি ছয় মাসের মধ্যে দু’চার দিনের জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেতে হতো। এভাবেই চলছিল তাঁর দিনকাল। ২০১৭ সালের শেষদিকে তাঁর নিজের এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী ইসমত হোসেনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
সাদেক হোসেন খোকার পরিবারের আরেক ঘনিষ্টজন মাহমুদ হোসেন বাদশা বলেন, এ অবস্থায় তাঁরা নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসুলেটে প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাদেরকে পাসপোর্ট না দেয়ায় এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে খোকা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তার সেই আবেদন এখনো অনিষ্পন্ন। এরমধ্যে দফায় দফায় কনসুলেটে খোঁজ নিয়েও পাসপোর্টের কোনো হদিস মেলেনি। সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে স্ত্রী ইসমত হোসেন সশরীরে কনসুলেটে গিয়ে পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি যথারীতিই পাসপোর্টের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
বাদশা জানান, বিরতিহীন চিকিৎসার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক মাস ধরে সাদেক হোসেন খোকা দেশে ফেরার জন্য অনেকটা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বলতেন, ঢাকায় যাওয়ার পর জেলে যেতে হলে যাবো, চিকিৎসার জন্য আর আসতে না দিলেও সমস্যা নাই। দেশে গিয়েই মরবো। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া দেশে যাবো কি করে?
মাহমুদ হোসাইন বাদশা বলেন, কাকতালীয়ভাবে খোকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ওপর যেদিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার তারিখ সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর। গাড়িতে চড়ে ইমিগ্রেশন অফিসে যাওয়ার সময় পুরোটা পথ নীরবে চোখের পানি ঝরিয়েছেন খোকা। এক পর্যায়ে পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে বললেন, ‘আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। যুদ্ধ করে এইদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ সেই বিজয় দিবসেই যাচ্ছি অন্য দেশে আশ্রয় চাইতে!’
তিনি বলেন, খোকা কেবল একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি মেয়র হওয়ার পর রাজধানী ঢাকার অনেকগুলো সড়কের নাম মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর কমান্ডার ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম বিজয় দিবসে নগরভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন। অথচ তার মতো একজন নিখাঁদ দেশপ্রেমিক মানুষের জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় দেশে ফেরা অনিশ্চিত। এরচেয়ে পরিতাপের আর কি হতে পারে? মৃত্যুর পর কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় তার মরদেহ দেশে নেয়া সম্ভব হলেও পাসপোর্ট না থাকায় স্ত্রী ইসমত হোসেন সঙ্গে যেতে পারবেন না। সেটা হবে আরো মর্মান্তিক বিষয়।
সাদেক হোসেন খোকার বড় ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন আজকালকে বলেন, ফুসফুসে মারাত্মকভাবে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ায় তার জীবন এখন বিপন্নপ্রায়। অথচ তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কিডনি ক্যানসারের। হঠাৎ করেই ফুসফুস আক্রান্ত হলে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তবে এখনো পর্যন্ত অক্সিজেন-সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে আছেন। চেতনাও অনেকটাই ঠিক আছে। সবাইকে চিনতে পারছেন। কিন্তু কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সারাক্ষণ দেশের কথা জিজ্ঞেস করেন। কেউ দেখতে এলেই জানতে চান, দেশের খবর কি। আর সারাক্ষণই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা খুবই বিভ্রান্তি ও হতাশার মধ্যে আছি। আব্বু-আম্মু কারো পাসপোর্ট নেই। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।
প্রসঙ্গত, কিডনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের মে মাসে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন সাদেক হোসেন খোকা। তারপর থেকে গত সাড়ে পাঁচ বছর যাবৎ থাকছেন নিউইয়র্ক সিটির ইস্ট এলমহার্স্ট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী ইসমত হোসেন। চিকিৎসার জন্য আসার চেষ্টায় ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের বাধায় প্রথম দফা তিনি ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের আদেশে তার বিদেশ গমনে বাধা দূর হলে প্রায় তিন সপ্তাহ পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ওই তিন সপ্তাহ বিলম্বের কারণেও ক্যানসার তার শরীরে অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান বড় মেয়ে সারিকা হোসেন। তিনি বলেন, তারপরও নিউইয়র্কে চিকিৎসা শুরুর পর গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তার ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় তিনি এখন সংকটাপন্ন। পিতার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন সারিকা হোসেন।