ছাত্রদলের দুরবস্থার জন্য বিএনপির হাইকমান্ডকে দুষছেন নেতারা
- এম টি রহমান
- প্রকাশ: ১৫ জুন ২০১৯, ১২:৩৭ PM , আপডেট: ১৫ জুন ২০১৯, ০৩:১৫ PM
২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও মো. আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। আংশিক ওই কমিটি ছিল ১৫৩ সদস্যের। যা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংখ্যার চেয়ে দুজন বেশি। এর ১৫ মাস ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি ১৫১ সদস্যের হলেও এতে জায়গা পান ৭৩৬ জন! সে সময় এমন কথাও ওঠে, ‘ছাত্রদলে কোনো কর্মী নেই, সবাই নেতা।’
জানা গেছে, রাজিব-আকরাম কমিটি প্রায় পাঁচ বছর পার করেছে। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ হওয়ার কথা দুই বছর। সে হিসেবে প্রায় আড়াইটি কমিটির সময় পার করেছেন তারা। অথচ এ সময়ে নিয়মিত কমিটি দেওয়া হলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আরও তিন শতাধিক নতুন নেতা পেত ছাত্রদল। এতে ছাত্রদল সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি বিএনপিও লাভবান হতো।
অবশ্য এ কমিটির কার্যক্রম এখন আর নেই। গত ৩ জুন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল করে বিএনপি। একইসাথে ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন করা হবে বলে জানানো হয়। পরে ছাত্রদলের কাউন্সিল উপলক্ষে তিনটি কমিটি গঠন করে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচন পরিচালনা, বাছাই ও আপিল কমিটির কথা জানানো হয়।
এরপরই আন্দোলনে নামেন ছাত্রদলের একটি অংশ। কারণ, নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্রদলের অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলে প্রার্থী হতে হলে ছাত্রদলের প্রাথমিক সদস্য হতে হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে পরবর্তীতে যেকোন বছরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
তবে এ নিয়ম মানতে রাজি নন ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির অধিকাংশ নেতা। তারা জানিয়েছেন, এভাবে কমিটি করা হলে ছাত্রদলের বড় একটি অংশ বঞ্চিত হবেন। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় তারা ছাত্রদল থেকে কিছুই পাননি। এখন এভাবে বয়সের সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে কমিটি করা হলে তাদের আর কিছুই করার থাকবে না। এজন্য অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়ার দাবি তাদের। এছাড়া কয়েকজনের ব্যক্তি স্বার্থে এ নিয়ম করা হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
অবশ্য তাদেরকে স্থান দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি করা হলে অধিকাংশ নেতার বয়স হবে ৩৫ বছরের ওপর। এছাড়া কয়েকজনের বয়স ৪০ বছরও ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন এ অবস্থার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে দায়ী করেন। তারা বলেন, ছাত্রদলের কমিটি দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত হচ্ছে না। একটি কমিটি ঘোষণা করা হলে তারা দু‘তিনটি কমিটির মেয়াদ পার করছেন। ফলে দীর্ঘ শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। প্রায় তিন বছর ধরে নতুন কমিটির তাগাদা দেয়া হচ্ছিল হাইকমান্ডকে। দুই বছর পরপর কমিটি করলে বয়স এমনিতেই নেমে আসতো।
তারা অভিযোগ করে বলেন, এটি না করে সুবিধাভোগী এবং সিন্ডিকেট মিলে হঠাৎ বয়স নামিয়ে পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি করতে চায়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের প্রেস বিজ্ঞপ্তির আগ পর্যন্ত তারা দলের নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী ছিলেন। আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত তারা মানেন না জানিয়ে বলেন, ‘হাইকমান্ড বলেছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তারা সমাধান বের করবেন। এজন্য সময় দিচ্ছি। সমাধান না এলে অচিরেই মাঠে নামবো আবারও। দাবি আদায় করবোই। সংকটের জন্য দল বা সিন্ডিকেট দায়ী, এর সমাধান দলকেই করতে হবে।’
আন্দোলনরত ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এসময় হামলা-মামলায় জর্জরিত ছাত্রদল নেতাদেরকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের কোনো খোঁজ নেননি। জেলে থাকলেও তাদেরকে তারা সহযোগিতা পাননি। এছাড়া বিএনপির অনেক নেতা ছাত্রদলের ব্যাপারে কোন খবর রাখেন না বলেও অভিযোগ তাদের। অথচ ছাত্রদলই বিএনপির রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় শক্তি বলে মনে করেন তারা।
ছাত্রদলের সদ্য বিদায়ী কমিটির এজমল হোসেন পাইলট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘২০০০ সালের এসএসসির যে ব্যাচের কথা বলা হচ্ছে তাতে বয়স হবে ৩৪/৩৫ বছর। এখানে আমরা যারা ৩৮/৩৯ বছরের তাদের দোষ কোথায়? আমাদের আপত্তিটা এখানেই। এতদিন যারা রাজনীতি করে আসলাম তাদেরও একটা চাওয়া-পাওয়া আছে। কিন্তু কোনো সুযোগ না দিয়ে এভাবে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নেব না।’
তিনি বলেন, ‘অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হোক। এরমধ্যে সবগুলো কমিটি হালনাগাদ করতে হবে। এরপর নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ এসময় সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কিছু লোকের ব্যক্তি স্বার্থের কারণে ছাত্রদল সঙ্কটে পড়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ছাত্রদলের সূত্রে জানা গেছে, আজ বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ছাত্রদলের ইস্যুটি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হতে পারে। এর আগে গতকাল বিএনপির বাজেট প্রতিক্রিয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের পর ছাত্রদলের নেতারা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেন। এসময় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তারা সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান করার ব্যাপারে তাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন।
শুধু কেন্দ্রীয় কমিটিই নয় ছাত্রদলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও একই ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় কমিটির পরই এ কমিটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গেই সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেখানেও নিয়মিত কমিটি না হওয়ায় একই ধরণের বয়সের জট তৈরি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা চাই ছাত্রদলের সবাইকে মূল্যায়ন করা হোক। সবাই একটি খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, নেত্রী জেলে রয়েছেন। এ অবস্থায় বাড়তি সমস্যা তৈরি করা ঠিক হবে না। আবার কাউকে বঞ্চিত করারও পক্ষে নই আমরা। এজন্য হুট করে বাদ না দিয়ে সবাইকে সুযোগ করে দিয়ে কমিটি করাটাই আমাদের দাবি।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালের পর ছাত্রদলের আটটি কমিটি করতে প্রায় ২৩ বছর পার হয়েছে। দুই বছরের কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ কমিটিই তিন বছরের বেশি সময় নিয়েছে। এতে অন্তত তিন থেকে চারটি কমিটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এগুলো নিয়মিত হলে আরও অসংখ্য নেতাকর্মী পেত বিএনপি ও ছাত্রদল- এমনটাই অভিমত অনেকের।