১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৬

১১ মাসে ৮৫২ রাজনৈতিক সহিংসতা: ৪৭৪টিই বিএনপির অন্তর্কোন্দল, আহত-নিহতও সর্বোচ্চ

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)  © লোগো

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর, এই এগারো মাসে ৮৫২ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯৬৬ জন। ৮৫২ টি রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে বিএনপি ও তার অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের অন্তর্কোন্দলেই ৪৭৪ টি ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনায় আহত ৪ হাজার ৫৭৭ জন ও নিহত ৮০ জন। 

বাকী ৩৭৪টি সহিংসতার ঘটনায় বিএনপিসহ জামায়াত, এনসিপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত। এসব দলের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন এবং আহত হয়েছেন ২ হাজার ৩৮৯ জন। 

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-নভেম্বর ২০২৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ১৫ টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও সংগঠনটির সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি। 

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এগারো মাসে কমপক্ষে ৮৫২ টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১২৯ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৯৬৬ জন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ পরায়ণতা, সমাবেশ কেন্দ্রিক সহিংসতা, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল কেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার ৮৫২ টি ঘটনার মধ্যে বিএনপি ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তর্কোন্দলে ৪৭৪ টি ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৫৭৭ জন ও নিহত ৮০ জন, ১৪১ টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৭৩৬ জন ও নিহত ১৯ জন, ৫৫টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৫০৩ জন ও নিহত ২ জন, ১৬টি বিএনপি-এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১৩৪ জন, ২১টি আওয়ামী লীগ-এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৫৭ জন ও নিহত ১ জন, ৮টি আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১০ জন ও নিহত ২ জন, আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে ১৩টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫৩ জন ও নিহত ৭ জন, এনসিপির অন্তর্কোন্দলে ১৪টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৫ জন, ৪টি জাতীয় পার্টি- গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৩৩ জন, পুলিশ-গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৩০ জন এবং ৮৬ টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। 

নিহত ১২৯ জনের মধ্যে বিএনপির ৯১ জন, আওয়ামী লীগের ২৩ জন, জামায়াতের ৩ জন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ১ জন, ইউপিডিএফের ৬ জন এবং চরমপন্থী দলের ১ জন। অপর ৩ জনের রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি যার মধ্যে ১ জন নারী রয়েছেন। ৮৫২ টি সহিংসতার ঘটনার ৭১৬ টিই ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ও বিএনপির সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। 

এর পাশাপাশি, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অন্তত ১৪২টি ঘটনায় অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন এবং দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। এসব হামলায় আওয়ামী লীগের ৩০ জন, বিএনপির ৫২ জন, জামায়াতের ১ জন নারী সদস্যসহ ৪ জন ও অন্যান্য দলের ৮ জনসহ ৯৫ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এছাড়াও গত এগারো মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৩০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, আট শতাধিক বাড়ি-ঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন: যুবদল কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা, বাড়িতেও আগুন দিল প্রতিপক্ষরা

প্রতিবেদন বলছে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন কেন্দ্রিক সম্ভাব্য প্রার্থী এবং বঞ্চিত কর্মী-সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, হরতাল, মহাসড়ক অবরোধ ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ, বাড়িঘর–কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। নভেম্বর মাসে নির্বাচনকেন্দ্রিক অন্তত ১৮টি সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৬২ জন এবং নিহত হয়েছেন ২ জন। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সরওয়ার হোসেন ওরফে বাবলা (৪৩) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এসময় নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, সরোয়ার ও শান্ত নামের তিনজন গুলিতে আহত হন। ঘটনাস্থলেই সরোয়ারের মৃত্যু হয়। এছাড়া, ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন দ্বন্দ্বের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে তানজিন আহমেদ (৩০) নামে এক ছাত্রদল কর্মী মারা গেছেন। নিহত তানজিন আহমেদ ময়মনসিংহ নগরীর দৌলত মুন্সিরোড এলাকার মৃত আবুল হোসেনের ছেলে।

সংগঠনটির তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২৯৩ টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৪২০ জন সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সব ঘটনায় হত্যা করা হয়েছে ২ জন সাংবাদিককে, আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ২৫৬ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৭৪ জন ও গ্রেফতার হয়েছেন ১৪ জন সাংবাদিক। এছাড়াও ৩১ টি মামলায় ১০৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে সুপারিশ জানিয়ে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন এবং সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি, যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দৃঢ় হয় এবং মানুষের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে মৃত্যু, রাজনৈতিক উত্তেজনা, নির্বাচনী সহিংসতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ-এসব বিষয় সমাধান করা না হলে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। তাই ‘এইচআরএসএস’ সরকারের প্রতি মানবাধিকার রক্ষায় আরও জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে এবং একই সাথে সব নাগরিক, গণমাধ্যমকর্মী, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতি অধিক সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানাচ্ছে।