১০ নভেম্বর ২০২৫, ২০:৫৭

নৈতিক স্খলন থেকে আওয়ামী তোষণ-অভিযোগের শেষ নেই আবু তাহেরের বিরুদ্ধে

বিএনপির প্রার্থী আবু তাহের তালুকদার  © টিডিসি সম্পাদিত

বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ক্ষমতাসীনদের সহযোগী ও দোসরদের অর্থের বিনিময়ে পুনর্বাসন, বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতে স্থান দেয়া, কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করে অন্য রাজনৈতিক দলের উপর তার দায় চাপিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা এবং নিজের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতনের একাধিক ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ায় নেত্রকোণা সংসদীয় আসন নেত্রকোণা-৫ (পূর্বধলা উপজেলা) বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রাথমিক সম্ভাব্য ঘোষিত প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির সম্ভাব্য এই প্রার্থী গেল বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন অসাধু উপায়ে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক বনেছেন। এই সময়ের মধ্যে নেত্রকোণা ও রাজধানী উত্তরায় তিনি বাড়ির মালিক হয়েছেন। 

নেতাকর্মীদের দাবি, বিতর্কিত লোককে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী না করে বিতর্কহীন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্য লোককে পূর্বধলায় মনোনয়ন দেয়া হোক। তাহলে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করবে। তা না হলে দল একটি নিশ্চিত বিজয়ী আসন প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেবে বলেও মতামত তাদের।  

অভিযোগের বিষয়ে পূর্বধলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের সম্ভাব্য মনোনীত প্রার্থী আবু তাহের তালুকদার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু দুষ্টু লোক এসব মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করছে। এসব অভিযোগ করে আমার বিজয়কে তারা থামাতে পারবে না। নির্বাচনে আমি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হব, এটা নিশ্চিত। প্রতিদ্বন্দ্বী দল জামায়াতের প্রার্থী সেখানে পাত্তাই পাবে না বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ যদি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমলেই নিতেন তাহলে আমাকে ধানের শীষের মনোনয়ন দিতেন না। মহাসচিব আনুষ্ঠানিকভাবে ২ অথবা ৩ তারিখে প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেছেন। অথচ আমাকে তার তিনদিন আগে আমাদের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম ভাই ডেকে নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছেন। 

আবু তাহের আরও বলেন, রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ আছে না? আছে যারা দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিল। তারা না পেয়ে কিছু বানোয়াট অভিযোগ, ভিডিও ফেসবুকে প্রচার করছে। কোনো নিউজ হয়নি। আমার একজন ক্ষতি চায়। দল তাকে আমার সদস্য সচিব করে চাপিয়ে দিয়েছে। সেই তার কিছু লোক দিয়ে এসব প্রচার করছে বলেও আবু তাহের অভিযোগ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই বিপ্লব পরবর্তীতে পূর্বধলাকে নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অশান্ত করার জন্য নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু তাহের তালুকদার। নেত্রকোনায় তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে নেতাকর্মীদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করে তিনি বক্তব্য দেন। সম্প্রতি সেই বক্তব্যের ভিডিও ফাঁস হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।  ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ছাত্রজীবন থেকেই খুব বিচক্ষণতার সাথে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দিয়ে আসছেন বলে দাবি করেন। তার বক্তব্যে নেতাকর্মীদের অপরাধে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করলেও তা ধামাচাপা দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা কোনো অপরাধ করলে জা,,,মা,,,,,,, উপর ,,,,। তার এ বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মী জানান, আবু তাহের নেতাকর্মীদের অপরাধে উৎসাহিত করার পাশাপাশি পূর্বধলায় অপরাধের অভয়ারণ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং ফৌজদারি অপরাধের শামিল।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পূর্বধলায় চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। ফিলিং স্টেশনে লুটপাটসহ সীমান্তবর্তী নেত্রকোণা জেলায় মাদকের চোরাচালান, ভারতীয় শাড়ি, কম্বল, চিনি কালোবাজারিসহ বিভিন্ন প্রকার অবৈধ ব্যবসা ও চোরাকারবারির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন আবু তাহেরের অনুসারীরা। মাদক ব্যবসায় এবং দখলদারিদের সাথে তার পরিবারের একাধিক সদস্যের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ উঠেছে। 

জানা যায়, গেল ৭ মে শ্যামগঞ্জে বাবাকে আটকে রেখে গৃহবধূর শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানির অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সরাসরি হস্তক্ষেপে পূর্বধলা উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়কের পদ হারানো মো. সালমান রহমান পল্লব আবু তাহেরের অনুসারী। বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা এবং ইসলামী বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীর ভাতিজির সাথে সংঘটিত এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় পূর্বধলা থানায় নারীনির্যাতন ও শ্লীলতাহানির মামলা করলেও তা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠে আবু তাহেরের বিরুদ্ধে।

এছাড়া, পূর্বধলায় পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন আবু তাহের এমন অভিযোগের ফিরিস্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সয়লাব। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি বেলালের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) সেলিম জাহাঙ্গীর এবং তার ভাইদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুটপাট, এবং একাধিক হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ বিপুল টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দেওয়াসহ তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে শেল্টার দেওয়ার দীর্ঘদিনের অভিযোগ আবু তাহেরের বিরুদ্ধে। 

মামলার আসামি হিসেবে সারাদেশে চলমান ডেভিল হান্টিংয়ের অংশ হিসেবে সেলিম জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানা পুলিশ। কিন্তু অভিযোগ উঠে তাহের গ্রেপ্তারকৃত জাহাঙ্গীরকে টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনার প্রচেষ্টা চালান।  

এছাড়া, পূর্বধলার ভুক্তভোগী মানুষ ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা জাহাঙ্গীর ও তার ভাই তুষারদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও তাদের তাহের শেল্টার দিচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর। 

আবু তাহের তালুকদার আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে খলিশাউড় ইউনিয়ন ৬ নং ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এবাদুল ইসলামকে বিএনপিতে যোগদান করিয়েছেন। খলিশাউড় ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি আদম আলী গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য প্রচারণা করেছে সে এখন আবু তাহের তালুকদারের লোক বলে পরিচয় দেয়। বিভিন্ন স্কুল মাদ্রাসার কমিটি দেওয়ার জন্য বড় অংকের টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদান বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন। 

খলিশাউড় ইউনিয়ন ৬ নং ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এবাদুল ইসলামকে টাকার বিনিময় বিএনপিতে যোগদান করিয়েছেন আবু তাহের। নারান্দিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জসীম উদ্দীনের ছেলে খুনের শিকার হয়। তখন আবু তাহের তালুকদার আসামির কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নাম ভাঙিয়ে মামলা থেকে তাদের রেহাই দিতে প্রায় ৮ লাখ টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের পলাতক এমপি আহমদ হোসেনের সহচর আজিম উদ্দিন মাস্টারকে ৩নং ঘাগড়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা করেছেন। 

এদিকে, সম্প্রতি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নমিনি আবু তাহেরের আলাদা আলাদা কয়েকটি অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ভিডিওতে তাকে অশ্লীলভাবে তার বিশেষ অঙ্গ সামনে কাউকে দেখানো ও দেখিয়ে দেখিয়ে ‘মাস্টারবেশন’ করতে দেখা যায়। যদিও ভিডিওতে কোনো শব্দ নেই। তবে সবকিছু স্পষ্ট। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর উপজেলার জনসাধারণের মাঝে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 

আবু তাহেরের ভিডিওর বিষয়ে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক এনামুল হক হলুদ বলেন, চার/পাঁচতলা বাড়ি করেছে রাজপ্রাসাদের মতো, রাজধানীর উত্তরায় বাড়ি করেছে; এসব কোথা থেকে এসেছে? তাছাড়া আবু তাহের নারী কেলেঙ্কারি। তার অশ্লীল ভিডিও বের হয়েছে। যে নারী কেলেঙ্কারি করে তার কাছে কি বিএনপির নমিনি নিরাপদ? নারীরা নিরাপদ? আমার মেয়ে, আমার সন্তান যদি একজন ক্যান্ডিডেটের কাছে নিরাপদ না থাকে, যদি মা-বোনরা নিরাপদ না থাকে; তাহলে তার কাছে কি বিএনপির নমিনেশন নিরাপদ?

এসব ছাড়াও আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পূর্বধলা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে নিয়োগ বাণিজ্য করে প্রায় ৩ লাখ, নারাইন ডহর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নিয়োগ বাণিজ্য করে ৫ লাখ, হাফেজ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন তিনি। 

এসব বিষয়েও জানতে চাইলে আবু তাহের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কিছু দুষ্টু’ লোক এসব বানোয়াট বিষয় ফেসবুকে ছড়াচ্ছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, কোনো নিউজ হয় নাই। আমি যদি খারাপ লোক হতাম, তাহলে কি মানুষ প্রতিবাদ করতো না? আজকেও কর্মসূচি পালন করলাম। সেখানে ৫/৭ হাজার লোক হয়েছে। ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠান করেছি। সেখানে প্রায় ২৫/৩০ হাজার লোক হয়েছিল। দুয়েকজন চক্রান্ত করে আমার বিজয় থামাতে পারবে না।  

উল্লেখ্য, নেত্রকোণা-৫ নির্বাচনী আসনে (পূর্বধলা উপজেলা) মোট ভোটার ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯টি। এর মধ্যে এক লাখ ৪৭ হাজার পুরুষ ও এক লাখ ৪২ হাজার নারী ভোটার। দুইজন ভোটার লিঙ্গগতভাবে হিজড়া।