‘বিচার নিশ্চিত না করে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা শহীদদের স্মৃতির প্রতি অবমাননা’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ (এইচআরডব্লিউ) ৬ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে দেশ ও দেশের বাইরে গবেষক, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের সংগঠন সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ। পূর্ণ জবাবদিহিতা ও বিচার নিশ্চিত না করে দলটিকে পুনরায় বৈধতা দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা শহীদ, নিখোঁজ ও নির্যাতিতদের স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা বলেও উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
আজ বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের সভাপতি ও কাতারের নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. হাসান মাহমুদ এবং সেক্রেটারি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির ইনস্ট্রাক্টর তাইয়িব আহমেদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়।
এর আগে গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। গত রবিবার এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে ওই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। চিঠি দেওয়া অপর ৫ মানবাধিকার সংস্থা হল- বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজের অধিকার রক্ষায় কাজ করা দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা সিভিকাস, রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন থাইল্যান্ডভিত্তিক ফোরটিফাই রাইটস, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট। তাদের চিঠিতে আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ দেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে একগুচ্ছ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি যৌথ চিঠি প্রেরণ করেছে, যেখানে অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের ধারাবাহিক আগ্রহ ও সম্পৃক্ততাকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই; তবে আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে দলটি পরিকল্পিতভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও গুমের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু করার প্রস্তাব গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’
আওয়ামী দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে এতে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন, শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯৭২–১৯৭৫) একদলীয় স্বৈরশাসন থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার (২০০৯–২০২৪) পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত একটি বংশানুক্রমিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে তুলেছিল, যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দমন-পীড়ন ও আতঙ্কের এক নজিরবিহীন যুগ প্রতিষ্ঠা করেছিল। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিচারব্যবস্থাসহ সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী মত দমন ও গণতান্ত্রিক পরিসর ধ্বংসের জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে র্যাব ও ডিজিআইএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৩,৫০০টি গুমের ঘটনা জাতীয় গুম তদন্ত কমিশন কর্তৃক ধারণা করা হয়েছে।’
এমন একটি দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোকে গণতান্ত্রিক বহুদলীয়তার ভুল অজুহাতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকারদের তাদের নির্যাতনকারীদের সঙ্গে আবারও সহাবস্থানে বাধ্য করার শামিল উল্লেখ করে সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে, জার্মানিতে নাৎসি পার্টি ও ইতালিতে ফ্যাসিস্ট পার্টিকে তাদের নৃশংসতা ও গণতন্ত্র ধ্বংসের অপরাধে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আজকের কোনো বিশ্বাসযোগ্য মানবাধিকার কাঠামো ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’–এর নামে ওই দলগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশও তার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বার্থে একই নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য। যারা জাতিকে একদলীয় শাসন ও রক্তাক্ত দমননীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ দেওয়া ইতিহাসের প্রতি অবিচার হবে। সুতরাং, আমরা বিশ্বাস করি পূর্ণ জবাবদিহিতা ও বিচার নিশ্চিত না করে আওয়ামী লীগকে পুনরায় বৈধতা দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা শহীদ, নিখোঁজ ও নির্যাতিতদের স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক সামঞ্জস্যের সঙ্গে মূল্যায়ন করুন। বিচার হতে হবে রিকন্সিলিয়েশনের আগে, কারণ বিচারবিহীন গণতন্ত্র কখনো টেকে না। আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান তাই অবিবেচনাপ্রসূত ও বিপজ্জনক।
উল্লেখ্য, দেশ ও দেশের বাইরে গবেষক, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের সংগঠন সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ ২০২৩ সালের ১২ জুলাই ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য ক্যাম্পেইন’- এই স্লোগানকে ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনীতিতে সততা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াসে একটি সিভিল সোসাইটি সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ।