০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১:৪২

ইসলামি দর্শন ছেড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কেন ঝুঁকেছিলেন বদরুদ্দীন উমর?

বদরুদ্দীন উমর  © ফাইল ছবি

দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন আজ রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর)। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারাল এক অকৃত্রিম চিন্তক ও সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসলেখককে। আমৃত্যু তিনি দেশের রাজনীতি, ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ নানা প্রসঙ্গে অকপটে মত প্রকাশ করেছেন। লেখালেখি ও গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় পদক ও পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। তবে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেননি। এমনকি এ বছর (২০২৫) স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও তিনি তা নেননি। তাঁর ব্যক্তিজীবন, মতাদর্শ ইত্যাদি আগ্রহ আছে অনেকেরই।

বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। গত দুই মাসে দুই দফায় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তাকে হাসাপতালে ভর্তি করা হয়েছিল বলে তার ঘনিষ্টজনেরা জানিয়েছেন। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। সুস্থ হওয়ার পর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। অগাস্ট মাসের শেষদিকে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আরেক দফা হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল।

২০০৩ সালে তার নিজের হাতে গড়া জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে রাজনৈতিক দলটির সভাপতি ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

ইসলামি ভাবধারা থেকে বামপন্থী রাজনীতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা বদরুদ্দীন উমর পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সেখানে তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ করেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন না এই গুণী।

বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। এক সময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। তাঁর বাবা আবুল হাশিম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন ছিলেন। ১৯৫০ সালে তারা সপরিবারে ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন।

বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে চিন্তা, আগ্রহ বা দায়বোধ তৈরি হয় মূলত পারিববারিক সূত্রে। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত। বদরুদ্দীন উমর তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শুরুর দিকে তার চিন্তা-ভাবনায় ইসলামি প্রভাব থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সেসময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা এবং জানাশোনা বাড়তে থাকে। তবে, অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার পর তার মার্ক্সপন্থী চিন্তা-ভাবনা পূর্ণতা পায়।

বদরুদ্দীন উমরের বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। পঞ্চাশের দশকে তার বাবা ঢাকায় 'খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামি আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল এ দলের আদর্শ। ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, জীবনের শুরুর দিকে বাবার প্রভাবে তার মধ্যে 'এক ধরনের ইসলামি চিন্তার আচ্ছন্নতা ছিল'। যে কারণে ভারত থেকে ঢাকায় আসার পরও তিনি তমুদ্দিন মজলিসের সঙ্গে বেশ কিছুদিন সম্পৃক্ত ছিলেন।

রাজনীতি ও চিন্তা

বদরুদ্দিন উমর ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে যুক্ত হন আরও পরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়ার পর তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট ধারায় রাজনীতি শুরু করেন। দেশে ফেরার পর প্রথমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দেন। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, অক্সফোর্ডে আন্তর্জাতিক বামধারার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পড়াশোনা তার মধ্যে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বোধ তৈরি করে। 

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘অক্সফোর্ডে তিনি সেরকম মানুষজনের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কাজ করেছেন, কথা বলেছেন, গবেষণা করেছেন। তার বিষয় যেহেতু ছিল রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি -এই বিষয়গুলো নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। দেশে ফেরার পর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক বোধ বা বুদ্ধিবৃত্তিক যে দায়বোধ সেটা তার মধ্যে শক্তিশালী ছিল।’

বলা যায় ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি বামধারার রাজনীতিতে চীনাপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। চীনাপন্থী বলে পরিচিত সুখেন্দু দস্তিদার, তোয়াহা, আব্দুল হকদের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে তিনি আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতায় ফেরেন নি। লেখালেখি ও বামপন্থী রাজনীতির চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশ এবং সেগুলো উভয় বাংলাতেই সমাদৃত। সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন নিয়মিত কলাম লিখেছেন।

কিন্তু ভাষা আন্দোলনের উপর লেখা তার তিন খণ্ডের বই 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টাকে একটা বিশ্লেষণী কাঠামোর মধ্যে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। সে কারণে তার এই গ্রন্থটা ইতিহাসের কারণেও গুরুত্বপূর্ণ, আবার অন্য দিক দিয়ে বিশ্লেষণ পদ্ধতি দেখার জন্য, কীভাবে একটা সময়কে, একটা ঘটনাকে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষতে বিচার করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে, সেটা পদ্ধতিগতভাবে বোঝার জন্য তার বইটা। মানে শুধু ভাষা আন্দোলন বোঝার জন্য না, গবেষণার ক্ষেত্রে দর্শনগত দিক থেকে কীভাবে একটা ঘটনা দেখা উচিত সেটা বোঝার জন্যও এই বইটা গুরুত্বপূর্ণ।’

বদরুদ্দীন উমর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সভাপতির দায়িত্ব নেন। 

বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে সাংবাদিকতা সূত্রে স্বাধীনতার পর পরিচয় হয় লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের। ১৯৭২ সালে গণকণ্ঠ পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমরের কাছাকাছি এসেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, গণমানুষের সমসাময়িক আন্দোলনে বদরুদ্দীন উমর অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তার মূল ভূমিকাটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক। তিনি বলেন, ইউরোপীয় কনসেপ্টে যেটা বলা হয় বা লাতিন আমেরিকায়ও এই জিনিসটা আছে সেটা হচ্ছে, 'অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল'। অর্থাৎ তিনি বুদ্ধিজীবী কিন্তু গণআন্দোলন বিবর্জিত না। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনীতির যে টানাপোড়েন আছে বা কন্টেম্পোরারি যে মুভমেন্টগুলো আছে সেটাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তার মূল কাজটি হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ।’ 

বদরুদ্দীন উমরের লেখা তিনটি বই 'সাংস্কৃতিক সংকট', 'সাম্প্রদায়িকতা' এবং 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' -এই বইগুলো পাক-ভারত উপমহাদেশ বিশেষত: বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বুঝতে পথিকৃৎ হিসেবে ভূমকি রেখেছে বলে অনেকেই মনে করেন। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,  ‘আমাদের দেশে সেক্যুলার রাজনীতির যে দার্শনিক ভিত্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং ইতিহাস বিষয়ের যে গবেষণা এটা আমি মনে করি সাতচল্লিশ পরবর্তী আমাদের সমাজে তিনি হচ্ছেন পথিকৃত। এবং এভাবেই আমরা তাকে মনে রাখবো। তার ঐ ধরনের কাজ এরপরে আর কেউ ঐ লেভেলে করতে পারেনি।’ 

তিনি ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে 'সংস্কৃতি' নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া গণকণ্ঠ ও হলিডে নামে পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের সঙ্গে নীতিগত বিরোধ থাকার কারণে তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি। চলতি বছর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষিত হলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেননি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা