২৮ জুলাই ২০২৫, ২০:২৬

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার, মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার  © টিডিসি সম্পাদিত

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ সাক্ষাতের সময় তার বড় বোন শারমিন আহমদ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা সাবেক নেতা কামরুল ইসলাম আফতাবও সঙ্গে ছিলেন। পরে সৌজন্য সাক্ষাতের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, সোহেল তাজের হাত ধরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার এই সাক্ষাৎ প্রতীয়মান হয় যে, প্রধান উপদেষ্টাও তাদের প্রতি নমনীয়। যদি তিনি না জেনে এই সাক্ষাৎ করে থাকেন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই আশা করি। তবে যেটাই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে ফিরিয়ে আনার কোনো চক্রান্তই বরদাশত করবেন না ছাত্র-জনতা।

অভিযোগ রয়েছে, সেন্টার ফর তাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ এন্ড এক্টিভিজম নামে একটি রিসার্চ সেন্টারের আড়ালে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এই নেতাকে পুনর্বাসন করছেন সোহেল তাজ। জানা গেছে, সঞ্জিত-সাদ্দাম কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন কামরুল ইসলাম আফতাব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও আ.লীগের এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে আফতাব

বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, ৫ আগস্টের আগে নিজ বিভাগে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের কাছে টপ পজিশনের (ফলাফলে) দিকে থাকা ছাত্রদেরকে শিবির বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন আফতাব। তাছাড়া নানা অজুহাতে বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিতেন, দেখাতেন ভয়। তাছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যার পক্ষ নিয়ে ফেসবুকে তার একাধিক পোস্ট ছিল। যদিও ৫ আগস্টের পরে তার টাইমলাইনে সেগুলো আর দেখা যায়নি। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও নেতাদের সঙ্গে তোলা একাধিক ছবি ও ছাত্রলীগের পদে থাকার প্রমাণ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রুমি আহমেদ নামে একজন ছাত্র ফেসবুকে লেখেন, ‘‘আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে যে ছেলেটি আওয়ামী মার্কা স্যারদের কাছে ছাত্রদেরকে শিবির বলে পরিচয় করিয়ে দিতো এবং ছাত্রলীগের পোস্টেড নেতা আফতাব যখন শারমিনদের সাথে প্রধান উপদেষ্টার সাহচর্য পায় তখন আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই থাকে না।’’

হাসানুল বান্না নামে বিভাগের আরেক ছাত্র লেখেন, ‘‘শারমিনের বা পাশে যে লোকরে দেখা যাচ্ছে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আমার সিনিয়র। তার নাম আফতাব। তাকে আমি স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের নিরেট দালাল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। আওয়ামী লীগের যে কোনো দুর্বৃত্তি ও হত্যার পক্ষ নিয়ে সে ফেসবুকে নিয়মিত সরব ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র জনতা হত্যার পক্ষ নিয়ে তার পোস্টের কারণে তাকে আমি ইচ্ছামতো গালাগালি করে আনফ্রেন্ড করে দেই। আজ দেখি আওয়ামী পান্ডা সোহেল তাজের ল্যাঞ্জা ধরে সে প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে আমরা এই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিতে চাই যে, সোহেল তাজের সাথে মিটিং সেটিং করার জন্য আপনাকে প্রধান উপদেষ্টার চেয়ারে বসানো হয় নাই। আপনি কার সাথে বসতে পারেন কিংবা পারেন না, আপনার যাবতীয় কর্মপরিধি জুলাই অভ্যুত্থানের নরমস, ভ্যালুসের উপর হতে হবে।’’

তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে কামরুল ইসলাম আফতাব দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কখনোই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমার বাড়ি ফরিদপুরে, সেখানের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাশ করি। এ ছাড়াও ছোটবেলায় কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। মাদ্রাসায় পড়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম।’’

তিনি দাবি করেন, ‘‘আমাদের একটা প্রোগ্রামের জন্য সোহেল তাজসহ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করি। উনাদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ছবি ছড়িয়ে পড়ে, এতে অনেকেই বিষয়টি অপছন্দ করছে। তাই হয়ত আমাদের এমন তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’’

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি জুবায়ের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘‘চিহ্নিত ছাত্রলীগ নেতা এবং সোহেল তাজ যাদেরকে ঘিরে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে তাদের এই মুভমেন্ট স্বভাবতই সন্দেহ উদ্রেক করে। তবে যেটাই হোক না কেন, আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার কোনো চক্রান্তই বরদাশত করা হবে না। কেননা আওয়ামী লীগের কোনো রিফাইন্ড ফর্ম হতে পারে না, এই দলটা আগাগোড়াই ফ্যাসিবাদের ধারক এবং বাহক। শাপলা, পিলখানা, জুলাই সহ নানা গণহত্যার কারিগর। তাদের রাজনীতি জুলাই অগাস্টেই সমাপ্ত হয়েছে। নতুন করে আর ফেরানোর সুযোগ নাই। ছাত্রজনতা সেই সুযোগ কাউকে দেবে না৷’’

ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় গণসংযোগ সম্পাদক মো. ফিরোজ আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খোলস পাল্টে নতুন পরিচয় ধারণ করে বিভিন্ন জায়গায় গেলেও স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করায় এটা প্রতীয়মান হয় প্রধান উপদেষ্টাও ছাত্রলীগের প্রতি নমনীয়। সরকার প্রধান কারো প্রতি নমনীয় থাকলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নমনীয় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি যদি না জেনে এই সাক্ষাৎ করে থাকেন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই আশা করি। প্রধান উপদেষ্টা সন্ত্রাসীদের উপর নমনীয় না হয়ে কঠোর হোক।’’

তিনি বলেন, ‘‘বিগত ১৭ বছরে ছাত্রলীগ সকল বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্পাস, বিভিন্ন অফিস-আদালত এবং সর্বশেষ জুলাই আগস্ট আন্দোলনে নির্মম হত্যাকাণ্ড করায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যার ফলে সরকার কেবলমাত্র ছাত্রলীগের সকল কার্যক্রম নয় বরং সংগঠনকেই ছাত্রসমাজের দাবির মুখে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে হয়েছে। আমরা দেখেছি এই নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র কাগজে-কলমে। বাস্তবে ছাত্রলীগের অপরাধীরা এখনো প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে যার অন্যতম কারণ হলো তারা সংখ্যায় অধিক হওয়ায় সংকটকালীন এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দলকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক দলই তাদের সহযোগিতা ও সুবিধা পেতে অতীতকে ভুলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গোপনে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে অনেক সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী থাকায় তারাও প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন।’’