০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৪৮

রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে হতাশা: আপনার করণীয় কী?

প্রতীকী ছবি

 নতুন বছরে নতুন আশায় বুক বেঁধে নতুন করে জীবন সাজাতে চায় সবাই। ভুলে যেতে চায় বিগত বছরের দুঃখ-বেদনা কিংবা পাওয়া-না পাওয়ার কষ্ট। ২০১৮ খুব খারাপ গেছে? কষ্ট পেয়েছেন, রাজনৈতিভাবে হতাশ হয়েছেন? জানা যাক নতুন বছরে ভালো থাকতে কী করা যেতে পারে। 

গল্পটা ‘দ্য অ্যাডাসিটি অব হোপ’ থেকে নেয়া। আমেরিকার সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ এটি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষ করার কিছুদিন পরই বিয়ে করেছিলেন ওবামা। সম্ভবত এ কারণে জীবন নিয়ে কিছুটা হতাশা ছিল তাঁর। ঠিক এ সময়ই ইলিনয় রাজ্যসভার একটি আসন শূন্য হয়। বেশ কজন বন্ধু তাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। বিষয়টিতে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যান ওবামা। নেমে পড়েন রাজনীতিতে। পাড়ার গলি থেকে ‍সুপার শপ, ক্লাবঘর থেকে বিদ্যালয়ের ঘর— সর্বত্রই চালাতে থাকেন প্রচার-প্রচারণা। যখন যেখানে যাকে পান, হাতে ধরিয়ে দেন নির্বাচনী প্রচারপত্র। কিন্তু ওবামা খেয়াল করলেন, প্রায় সব স্থানেই তাকে দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেটি হলো— প্রথমত: তোমার নামটি সুন্দর, কোথায় পেয়েছ? দ্বিতীয়ত: তোমাকে তো বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হয়। রাজনীতিতে কেন এলে?

ওবামার সহজ উত্তর— ‘রাজনীতির নোংরামি ও নৈরাশ্যকর দিক সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু এরও তো একটা ঐতিহ্য আছে।’ মানতেই হবে রাজনীতির ঐতিহ্য আছে। তা না হলে দুনিয়া পাল্টালো কী করে? সত্যি বলতে কী, রাজনীতিতে ভালো-মন্দ উভয়ই আছে।

হিটলার, মুসোলিনি কিংবা পিনোশের মতো রাজনীতিবিদরা যেখানে পৃথিবীটাকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। ঠিক সেখানে আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতারা টেনেছেন সামনের দিকে। আসলে দায়টা শুধু হিটলার-মুসোলিনির না-কি দায়িত্বটা মহাত্মা গান্ধী কিংবা বঙ্গবন্ধুর।  ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক, মজুর, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষদের কি কিছুই করার নেই? আছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল বলেছিলেন, রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুধু রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। নিজেদেরও তো দায় আছে। তাছাড়া আশা-নিরাশায়ই তো জীবন। কী আছে, কী নেই, সেই দোলাচলে মন পড়ে যায় বিপাকে। নিরাশার পাল্লাটা ভারী হতে হতে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাতেই কি জীবনের গতি থামিয়ে দিতে হবে? সব সময় জীবনে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব না কষে নতুন করে ভাবুন। চিন্তা করুন আনন্দের মুহূর্তগুলো নিয়ে।

রাজনৈতিক হতাশার পাশাপাশি সামাজিক হতাশাও ছেয়ে গেছে সর্বত্র। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলস শিক্ষক রিসার্চ ফেলো ড. ড. হাসান মাহমুদ মনে করেন, অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও চলমান অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহে আশাবাদী হওয়ার বদলে হতাশার জন্ম দেয়। এর প্রধান কারণ হলো, সবার মধ্যে পারস্পরিক যে সম্পর্কজাল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগসূত্র, তার ক্রমাগত বিভাজন। দল-মত-পথ নির্বিশেষে সবাই যেন একে অন্যের সহযোগীর বদলে হয়ে পড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু তা-ই নয়, সেই প্রতিযোগিতায় যেকোনো উপায়ে জয়ী হওয়া কিংবা অন্যকে পরাজিত করাই যেন একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। সামগ্রিক পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর রেষারেষির কারণে জাতীয় রাজনীতির অচলাবস্থা, অনিয়ম আর দুর্নীতির মহামারী থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়ে আক্রোশ আর হানাহানি হয়ে পড়েছে আমাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের বাস্তবতা। ফলে দেশের অর্থনীতিতে ক্রমাগত উন্নয়ন চলতে থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তার প্রতিফলন ঘটছে না।

বাংলাদেশের সমাজ যে আজ এহেন সমস্যার মুখোমুখি, এর কারণ কী? এ অবস্থা থেকে উত্তরণইবা কোন পথে? নতুন বছর আসলে মনের অজান্তেই হোক বা সজ্ঞানেই হোক— নতুনভাবে জীবনকে নিয়ে আমরা ভাবি। পুরোনো বছরের সব অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন বছরকে সাজাতে শুধু ভাবলেই হবে না, নিতে হবে কিছু পদক্ষেপ। হয়ত বদলে যেতে পারে জীবনের গতিপথ।

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মানুষই পুরনো চিন্তার খোলস থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে

 

নিজেকে সময় দিন
অন্যকে পেছনে ফেলার তাগিদে বা সাফল্য পাওয়ার আশায় আমরা ছুটে চলছি প্রতিনিয়ত। দিন দিন মানুষ ব্যস্ত থেকে আরো ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে প্রাপ্তির বদলে কোথায় যেন এক ধরনের অস্থিরতা আর ক্লান্তি। সব কিছুর পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেলছি আমরা। নিজের ভালোলাগাগুলো আজ চাকচিক্যময় ব্যস্ত জীবনের আড়ালে হারাতে বসেছে। অনেকক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও বুঝি না, বুঝলেও সেই অস্থিরতাকে সফলতা দিয়ে ঢেকে নিজেদেরই বোকা বানাই। তাই অস্থিরতা, ক্লান্তি, ভালো না লাগা পিছু ছাড়ে না আমাদের। তাই নতুন বছরে শত ব্যস্ততার মাঝে, সফলতার পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে একটু সময় দিন। এই সময় শুধুই আপনার।

নিজের কাজে সৎ থাকুন
নিজের কাছে আর নিজের কাজে সৎ থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় সফলতা। সমাজ, দেশের উপকার করার জন্য আর্থিক আর শারীরিকভাবে সামর্থ্য সবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু নিজের কাছে, নিজের কাজের ক্ষেত্রে সততা দেখাতে পারে যে কেউ। ভুললে চলবে না, আমরা যাই করি না কেন এর প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই সমাজ আর দেশের ওপর-ই পড়ে। বছরের প্রথম থেকেই এই ব্যাপারে সচেতন হোন।

ফেসবুকের বদলে বই
সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে মানুষ ক্রমেই যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার, গড়ে উঠছে একক জগৎ। বিশ্লেষকরা বলছেন, মন ভালো করতে দিতে একটি বই-ই যথেষ্ট। অবসর কিংবা যানবাহনে যাওয়ার সময় সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকেন? এখান থেকে পাওয়া পক্ষে-বিপক্ষের সংবাদগুলোর আপনার মানসিকতা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। তাই একটু অন্য রকম করে দিন নিয়ম। বই পড়তে ভালবাসলে বা গান শুনতে পছন্দ করলে এই সময়টা কাজে লাগান। এতে সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তিও কমবে আবার প্রিয় শখ বজায়ও থাকবে।

ভারী প্রতিজ্ঞা নয়
ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাজনীতিতে ধরা পেয়েছেন? সমস্যা নেই। পুরনো ভুলত্রুটি শুধরে নতুন বছরে জীবনের পথ আরও সুগম করে তুলতেই ‘নিউ ইয়ার রেজলিউশন’নিয়ে থাকতে হবে। যদিও তার অনেকটাই বছরের মাঝপথে এসে আমরা রক্ষা করতে পারি না। তাই ভারী কোনও প্রতিজ্ঞা নেওয়ার দরকার নেই। বরং প্রতি দিনের রোজনামচায় কোনও কোনও স্বভাব বদলে ফেললেই এ বছরটা আরও সুন্দর ও সফল হয়ে উঠতে পারে।

আত্মসম্মান বোধের বিকাশ
সম্মান যেমন যেকোনো সম্পর্কের অলংকারস্বরুপ ঠিক তেমনি আত্মসম্মান যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের অপরিহার্য অংশ। আত্মসম্মানহীন বা মর্যাদাহীন মানুষকে অন্য মানুষরা গোনায় ধরে না, নানাভাবে অপমান করে। যদিও এমন ব্যবহার মানবিকতার বিপক্ষে। তবুও নিজের আত্মসম্মান আছে এটা অন্যকে বুঝিয়ে দিন। নিজেকে বার বার অন্যের অপমানের পাত্র করবেন না। ভালোবাসার নামে, কাউকে ভালোবাসলে আমরা নিজের আত্মসম্মানকে ভুলে শুধুই ভালোবাসি বা অন্যের অপমান সহ্য করি। মানুষ একে ভালোবাসার প্রকাশ ভাবে না, ভাবে দূর্বলতা। তাই নিজের আবেগ বা ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্মান করুন। আত্মসম্মান থাকলে কেউ আপনাকে নিয়ে বা আপনার আবেগ নিয়ে দিনের পর দিন অপমান করতে পারবে না।

সমস্যা হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে দিশেহারা হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না

 

রাগকে নিয়ন্ত্রণ করুন
মান অভিমান, রাগ মানব চরিত্রের অংশ। রাগ ছাড়া মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগ ধ্বংসের কারণ। কথায় আছে- রাগ করলেন তো হেরে গেলেন। তাই রাগের নিয়ন্ত্রণ খুব প্রয়োজন। দার্শনিক সেফটিস বারি বলেছেন, রাগকে শাসন না করা হলে রাগই সম্পূর্ণ মানুষটাকে শাসন করে। অন্য একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে- যে লোক রাগতে জানে না সে মূর্খ্য, কিন্তু যে রাগ করে না সে বুদ্ধিমান।

‘না’ বলতে শিখুন
জীবনের চলার পথে এমন অনেক পরিস্থিতি আসবে, যেখানে না বলতে হবে। না বলা মানেই নয়, আপনি ভালো না, আপনার যোগ্যতা কম। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সম্পর্কে যা আপনি নন, যা আপনি করতে পারবেন না, যা আপনার মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। সেখানে কোনো প্রকার অপরাধবোধ ছাড়া না বলুন। না বলার সময় কন্ঠে দৃঢ়তা থাকবে কিন্তু অন্যের কথা বা প্রস্তাবে কোনো অবজ্ঞা বা বেয়াদবি প্রকাশ করবেন না। অন্যের কথার সঙ্গে একমত না হন, কাজ করতে না পারুন বুঝিয়ে বলুন।

আশায় বাঁচুন
হতাশার লক্ষণ হলো মন ভালো না থাকা, কাজে আগ্রহ না থাকা, ক্ষুধা ও ঘুম কমে যাওয়া, ওজনের পরিবর্তন হওয়া। খুব বেশি হতাশ হয়ে পড়লে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। জীবনের পরিবর্তনগুলোকে মেনে নিতে চেষ্টা করুন। যেকোনো বিষয়ে তাদের অতিরিক্ত চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। যদি মনে হয়, বেশি হতাশ হয়ে পড়ছেন, তাহলে কোথা থেকে ঘুরেও আসতে পারেন। মোট কথা জীবনকে নতুন করে ভাবতে শুরু করুন। বিপদে মনোবল না হারিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজের শপথ নিন। কখনোই নিজেকে ছোট ভাববেন না। মনে রাখবেন যে ব্যাক্তি যত উৎফুল্ল, তার কাজ করার ক্ষমতা তত বেশি। আর চলার পথে মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট আসবেই। সেগুলোকে অতিক্রম করার সাহস রাখুন। 

সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন
প্রার্থনা করুন। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে সবচেয়ে ভালো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। তাছাড়াও প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান আপনার জীবনের সব কিছুর জন্য। এর জন্যও ধন্যবাদ জানান, অনেকের চেয়ে আপনি অনেক ভালো আছেন। আপনার চেয়েও বহু মানুষ অনেক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে, কিন্তু তারা কখনো হার মানেনি। এটাও আপনার জীবনের অনেক বড় শিক্ষা হতে পারে। জীবন কঠিন হতে পারে, কিন্তু হার মানা যাবে না। লড়াই করে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। আর এই শক্তিটাও পাওয়া যাবে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। তাই শত ব্যস্ততায়ও প্রার্থনা করুন।

আমাদের সামাজিক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আমাদের জৈবিক সংহতি তথা ভিন্নতার মাঝে ঐক্যের ভিত্তিতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে তথা পুরো সমাজের ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। যেকোনো দল বা মতকে ‘একমাত্র সঠিক’ ধরে নিয়ে অন্যদের দমন, নির্যাতন, নিপীড়ন চলতে থাকলে অবস্থা বর্তমানের থেকেও ক্রমাগত খারাপ হবে। আর হতাশা আর দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে মনে রাখতে হবে- পৃথিবীকে দেয়ার মত আপনার কাছে এখনও অনেক কিছুই বাকি। তাই নিজেকে অহেতুক ছোট না ভেবে নিজের মত করে বাঁচুন এবং আনন্দে থাকুন।