২৮ মে ২০২৫, ১৮:৩৪

নিয়মিত ধ্যানে গড়ে উঠুক সুস্থ, সফল, সুখী জীবন

ধ্যান  © সংগৃহীত

জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারাই একজন মানুষের প্রকৃত শক্তি। এই মনোভাবই মহামতি গৌতম বুদ্ধকে অমর করে রেখেছে ইতিহাসে। মৃত্যুর আগে শেষ বয়সে এক ভণ্ড শিষ্য যখন প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়, তখন বুদ্ধ তার মনোবাসনা বুঝেও কিছু বলেননি। বছরের পর বছর ওই ভণ্ড সন্ন্যাসী ধ্যানের গূঢ়তত্ত্ব বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে একদিন বুদ্ধকে গালিগালাজ শুরু করে। বুদ্ধ শান্ত কণ্ঠে শুধু একটি প্রশ্ন করেন—“তুমি যদি কাউকে কিছু দিতে চাও, কিন্তু সে না নেয়, তাহলে সেই জিনিস কার থাকবে?” উত্তরে শিষ্য বলল, “আমার।” বুদ্ধ তখন বললেন, “তাহলে তুমি আমাকে এতক্ষণ যা বলেছ, আমি তার কিছুই গ্রহণ করিনি।”

এই গল্প শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, আজকের পৃথিবীতেও প্রাসঙ্গিক। আমরা প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে উত্তেজনার মুখোমুখি হই। সামান্য ভাড়া নিয়ে রিকশাচালককে মারি, বা কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গিয়েই পরিবারের সদস্যদের উপর রাগ ঝাড়ি। এসবই রিঅ্যাকটিভ আচরণ—যা সমাজে অস্থিরতা ও হিংসার জন্ম দেয়। এর প্রতিকার হতে পারে ধ্যান বা মেডিটেশন।

বিশ্বজুড়ে ২০২১ সাল থেকে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মেডিটেশন দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য: “নিয়মিত মেডিটেশন: সুস্থ, সফল, সুখী জীবন”—এমন একটি বার্তা, যা প্রত্যেক মানুষের কাম্য।

ধ্যানের শক্তি: বাস্তব উদাহরণ
ধ্যানের প্রভাব শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বাস্তব জীবনে অনেক সময় জীবন-মৃত্যুর ফারাক তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য রবার্ট মুলার ছিলেন গেস্টাপোর খাতায় খুঁজে মারার তালিকায়। একদিন তাঁকে ধরতে নাৎসি বাহিনী তার অফিস ঘিরে ফেলে। তবে ধ্যান ও ইতিবাচক চিন্তার প্রভাবে মুলার নিজেকে থ্রিলার গল্পের নায়ক হিসেবে কল্পনা করে মাথা ঠান্ডা রাখেন। সেজে নেন সাধারণ কর্মচারীর ভান। ঠান্ডা মাথায় গেস্টাপোর সামনে দিয়েই বেরিয়ে যান নিরাপদে। বাস্তব ঘটনাটিকে সিনেমাটিক মনে হলেও এটি ছিল তাঁর ধ্যানের ফলেই সম্ভব।

ধ্যানচর্চায় ফিরে আসা জীবন
মার্কিন নিউরোসায়েন্টিস্ট জো ডিসপেনজা ১৯৮৬ সালে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ছয়টি কশেরুকা চূর্ণ হওয়ার পর চিকিৎসকদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিয়মিত ধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে নিরাময় করেন। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে তিনি কল্পনায় দেখতেন তাঁর মেরুদণ্ড কীভাবে স্বাভাবিক হচ্ছে। মাত্র ১০ সপ্তাহের মধ্যে তিনি হাঁটতে শুরু করেন এবং কর্মস্থলেও ফিরে যান। এরপর থেকে তিনি ধ্যান ও মনের শক্তি নিয়ে গবেষণাকে জীবনপথ হিসেবে বেছে নেন।

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপকারিতা
হার্ভার্ডের চিকিৎসক ডা. হার্বার্ট বেনসনের গবেষণা অনুযায়ী, ধ্যান শরীরকে শিথিল করে, হৃদস্পন্দন কমায়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ শক্তিশালী করে। এতে মানুষ আরও স্থির, ধৈর্যশীল এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ধ্যান শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সহায়ক
করোনার পর অনলাইনে দীর্ঘ সময় ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা ও হতাশা বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত ধ্যানচর্চা চালু করেছে। বাংলাদেশও এই উদ্যোগে পিছিয়ে নেই। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য মেডিটেশন চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়।

ধ্যান শুধু একান্ত ব্যক্তিগত অনুশীলন নয়—এটি একটি সামাজিক আন্দোলন হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিয়মিত মেডিটেশনের আওতায় আনে, তাহলে আমরা অনেক সুস্থ, সংবেদনশীল, ও সচেতন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব।

মেডিটেশন দিবসে তাই হোক একটাই সংকল্প: “মাথা ঠান্ডা রেখে মগজ ঠান্ডা করার এই পথেই হোক সক্রিয়, সৎ, ও সুন্দর জীবনের শুরু।”