একুশে পদক জয়ী প্রথম বিসিএস ক্যাডার কামাল চৌধুরী
জাতীয় ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এবছর যে ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি একুশে পদক পাচ্ছেন কবি কামাল চৌধুরী আছেন তার মধ্যে। আজ বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এই পদক প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়। তাতে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অসামান্য এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) তিনি কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেই খ্যাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকাল থেকেই কাব্যচর্চাকে জীবনের সঙ্গী করে নেন তিনি। কর্মজীবনেও উচ্চপদে রেখেছেন মেধা-বিচক্ষণতার স্বাক্ষর। আবারও অলঙ্কৃত হলেন রাষ্ট্রীয় সম্মানায়।
১৯৫৭ সালে ২৮ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয় করা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কামাল চৌধুরী। বাবা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মা বেগম তাহেরা হোসেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। পরে ২০০০ সালে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
১৯৮২ সালের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৩ সালে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি-জীবনে তিনি মাঠ পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। অতপর ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি শেরপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হিসেবে যোগদান করে ২০০৮ সালে অতিরিক্ত সচিব এবং ২০১০ সালে সরকারের সচিব পদে পদোন্নতি পান।
তিনি তথ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তাকে সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসর নেন। পরে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট ও ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুর সিভিল সার্ভিস কলেজ, ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউট, ইরানের তেহরানস্থ আইসেস্কো আঞ্চলিক কার্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল ফর এডুকেশন রিসার্চ (এসিইআর) মেলবোর্নসহ অস্ট্রেলিয়ায় পেশাগত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় ১৯৮১ সালের বাংলা একাডেমি বইমেলা উপলক্ষ করে একদল তরুণ কবি জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কামাল চৌধুরী তাদেরই একজন। এ উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রাবিড় প্রকাশনী। একুশের বইমেলাতেই বেরিয়েছিল কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’। এ বইয়ে কবিতার সংখ্যা ছিল ৪৮টি। এ বইয়ের কবিতার ভাষা ও শৈলী বলে দেয় কবি শামসুর রাহমান তাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। এরপর চাকরি জীবনের ব্যস্ততা তাকে কবিতা থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দেয়। ’৮১ থেকে ’৯০ একটানা নয় বছর কোনো কবিতার বই প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে।
এই ক্ষরা কেটে যায় ১৯৯১ সালে। এ বছর প্রকাশিত হয় কামাল চৌধুরীর দ্বিতীয় কবিতা সংকলন ‘টানাপোড়েনের দিন’। অতঃপর একে একে আরও আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো এই পথ এই কোলাহল, এসেছি নিজের ভোরে, এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা, ধূলি ও সাগর দৃশ্য ২, রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল, হে মাটি পৃথিবীপুত্র, প্রেমের কবিতা এবং পান্থশালার ঘোড়া। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রকাশ করেছেন একটি বাছাই সংকলন ‘নির্বাচিত কবিতা’।
এই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে প্রকাশ করেছেন ‘কবিতা সংকলন’। ১১টি গ্রন্থ থেকে ৩০৯টি কবিতা এ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া কামাল চৌধুরী ২০০৭ সালে প্রকাশ করেন কিশোর কবিতা সংকলন ‘আপন মনের পাঠশালাতে’। ১৯৯৫ সালে আলী রীয়াজের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সত্তরের দশকের কবিদের কবিতা।
কবি কামাল চৌধুরীর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এখন পর্যন্ত একাধিক পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে রুদ্র পদক (২০০০), সৌহার্দ্য সম্মাননা (পশ্চিমবঙ্গ) (২০০৩), কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪), জীবনানন্দ পুরস্কার (২০০৮), সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), দরিয়ানগর কবিতা সম্মাননা (২০১০) ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১১)।