কুয়াশা সিরিজের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে বিচরণ কাজীদার

কাজী আনোয়ার হোসেন
কাজী আনোয়ার হোসেন  © সংগৃহীত

লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার পুত্রবধূ মাসুমা মাইমুর ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ খবর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। তাঁরা ছিলেন চার ভাই, সাত বোন।

আরও পড়ুন: মাসুদ রানা-খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন

ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিণ কোণে যে দুটি দোতালা গেস হাউজ আজও দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাড়ি বদল করে তারা দক্ষিণ দিকের গেস্ট হাউসে চলে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কিছু অংশ দক্ষিণ দিকে ছিল। ড. কাজী মোতাহার হোসেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে অবশ্য তারা বাসা বদল করে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাসায় চলে আসেন।

তিনি ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিল।

তাঁর তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনো রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন।

১৯৬২ সালে কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাক কাজী আনোয়ার হোসেন ছেড়ে দেন ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৩ সালে মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকিটাকা দিয়ে টাইপপত্র।

আরও পড়ুন: মাসুদ রানা সিরিজ নিজেদের দাবি দুই লেখকের

দুজন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের শুরু, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী। পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তার।

১৯৬৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয় কুয়াশা-১, যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ। কাজী আনোয়ার হোসেনের এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। তাঁর মেয়ে শাহরীন সোনিয়া কণ্ঠশিল্পী। বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখির এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত।

সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে কাজী আনোয়ার হোসেন ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিল। কুয়াশা চরিত্রটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৭৬টির মতো কাহিনি রচনা করেছেন।

কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে রচিত। কুয়াশা সিরিজের কুয়াশা-১-এর মাধ্যমে লেখালেখির জগতে বিচরণ ঘটে তাঁর।

তাঁর ভাষাশৈলী অসাধারণ রকমে স্বাদু। মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি প্রধানত সম্পাদকের কাজ করেন, যদিও প্রকাশের ক্ষেত্রে বইগুলো তাঁর নামেই প্রকাশিত হয়।

উল্লেখ্য, যারা তাঁর হয়ে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কথাসাহিত্যিক শেখ আব্দুল হাকিম ও ইফতেখার আমিন। বিভিন্ন সূত্রমতে জানা যায় যে, শেখ আব্দুল হাকিমের হাত দিয়েই মাসুদ রানা সিরিজের সর্বাধিক জনপ্রিয় বইগুলো লেখানো হয়েছে।

তবে এটা বলতেই হবে যে- প্রায় ১০০ জনের বেশি লেখক-অনুবাদক তৈরি হয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে। আজকের বিভিন্ন নামকরা গণমাধ্যমে যাঁরা কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁদের অনেকেই সেবা, রহস্যপত্রিকা বা কিশোরপত্রিকারই প্রত্যক্ষ সৃষ্টি। আর পরোক্ষভাবে যে কতজন আছেন, তার ইয়ত্তা নেই। লেখালেখি করে জীবিকা অর্জনের দুঃসাহস সেবাই জুগিয়েছে তাঁদের অনেককে।


সর্বশেষ সংবাদ