হাসান আজিজুল হক: সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি

হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক  © সংগৃহীত

হাসান আজিজুল হক। উপমহাদেশের খ্যাতনামা এক কথাসাহিত্যিকের নাম। যার মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গি, সুঠাম সাহিত্যকর্ম, বাস্তববাদী চিন্তাধারা ও জীবন সংগ্রামী লেখনি জাতিকে যেমন করেছে তৃপ্ত তেমনি যুগিয়েছে প্রেরণা।

ভারতে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করা এই সাহিত্যেকের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় তরুণ বয়সেই। দর্শন শাস্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করলেও লেখালেখি ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে সাহিত্যে সৃষ্টি করেন এক নতুন পথ।

তাছাড়া সময়ের পরিবর্তনে মানুষের জীবনমানেও পরিবর্তন আসে; সেই পরিবর্তনের পরও মানুষের রূঢ়-বাস্তবতার বহু চিত্র আলোচনার বাইরে থেকে যায়। সেই রূঢ়-বাস্তবতার স্বরূপ অনুসন্ধানকে যারা কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছেন, হাসান আজিজুল হক ছিলেন তাদেরই একজন। কেননা, এই কঠিন কাজে সফল হতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

শুধু তাই নয়, একজন দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুক্ষ্ম অন্তদর্শনের মাধ্যমে তুলে এনেছেন নাগরিক জীবনের প্রসঙ্গও। ফলে তাঁর লেখায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের পাওয়া না-পাওয়া ও সংকটের চিত্র অঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি উড়ন্ত পতঙ্গের মতো মানুষ কীভাবে কঠিন-বাস্তবতার অগ্নিতে দগ্ধ হয় তা উঠে এসেছে। বস্তুত তার শিক্ষকতা ও লেখকসত্তা আলাদা করা কঠিন।

কেননা শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেও লেখা থেকে অবসর নেননি তিনি। গভীর জীবন দর্শনের স্বরূপ উদঘাটনে সর্বদা ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তার লেখা পাঠককে এমন মূল্যবোধের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে, যা তাদের সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টির মঙ্গলে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করতে উৎসাহিত করে। এমনি এক দার্শনিক ও কথাসাহিত্যিক ছিলেন হাসান আজিজুল হক।

সেই ধারাবাহিকতায় জীবনের রূঢ় বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে যুগের পর যুগ সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক। ফলে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি।

কেননা এই কথাসাহিত্যিকের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ এর ‘শকুন’ গল্পে সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন। এছাড়াও প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা।

যার মধ্যে রয়েছে ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’, ‘সারা দুপুর’ ও ‘কেউ আসেনি’।

১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই একজন ব্যাতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন হাসান আজিজুল হক। অচিরেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সবগুলো পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে।

ফলে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয় সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)-এর মতো তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ।

এখানেই শেষ নয়, একটি গ্রামীণ পরিবারের উত্থান-পতনের ইতিহাস তুলে ধরে নিজের এবং তার চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে নানান পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত রচনা করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আগুনপাখি। তাঁর অন্যন্য উপন্যাস গ্রন্থ হচ্ছে সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩), শামুক (২০১৫) এবং বৃত্তায়ন (১৯৯১)।

এছাড়া জর্জ শেহাদের নাটকের ভাষান্তর করে সম্পাদনা করেন 'চন্দর কোথায়' নাটক। শিশুতোষ সাহিত্যে লালঘোড়া আমি, ফুটবল থেকে সাবধান এবং আত্মজীবনীতে 'ফিরে যাই, ফিরে আসি (১ম অংশ, ২০০৯), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২য় অংশ, ২০১১), টান (২০১২), লন্ডনের ডায়েরি (২০১৩), এই পুরাতন আখরগুলি (৩য় অংশ, ২০১৪) ছাড়াও গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলী (তিন খণ্ড, ১৯৭৯), দুই বাংলার ভালোবাসার গল্প (যৌথ, ১৯৮৯), একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন (২০০০), কুসুমে কুসুমে স্মারকচিহ্ন (অধ্যাপক মফিজউদ্দিন স্মারকগ্রন্থ), জন্ম যদি তব বঙ্গে (সারোয়ার জাহান স্মারকগ্রন্থ), বং বাংলা বাংলাদেশ (যৌথ, সনৎকুমার সাহা সম্মাননাগ্রন্থ, ২০১২ ও রমেন্দ্রনাথ ঘোষ : দার্শনিক প্রবন্ধাবলি (যৌথ, ২০১৪) গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।

প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টিশীল লেখনির জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন। ১৯৬৭ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে একুশে পদক, ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডি-লিট উপাধিসহ সর্বশেষ ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

এছাড়াও অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার (১৯৯৪), খুলনা সাহিত্য মজলিশ সাহিত্য পদক (১৯৮৬), রাজশাহী লেখক পরিষদ পদক (১৯৯৩), সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৭), দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশিচমবঙ্গ) (১৯৯৭), শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৯), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০০২), আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (হবিগঞ্জ) (২০০৩), ক্রান্তি পদক (২০০৪), অমিয়ভূষণ সম্মাননা (জলপাইগুড়ি) (২০০৪), গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সম্মাননা (২০০৬), আগুনপাখি রচনার জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা বই (২০০৭), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৭), আনন্দ পুরস্কার (২০০৮), হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬), সেলিম আল দীন লোকনাট্য পদক, শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), সাহিত্য রত্ন পুরস্কার ইত্যাদি।

শিক্ষা জীবনে ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে খুলনা শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শনে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য অস্ট্রেলিয়া গেরেও অধ্যয়ন শেষ না-করেই দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথম যৌবনেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে চরম নির্যাতন ভোগ করেছেন হাসান আজিজুল হক।

কর্মজীবনে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এ সাহিত্যক। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। ২০০৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য মনোনীত হন এবং দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি ২০১৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।

গত ১৫ নভেম্বর বিশিষ্ট এই কথাসাহিত্যিক তাঁর নিজস্ব বাসভবন ‘উজান’ তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে ‘বিহাস’ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থ্যতায় আক্রন্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ১৬ নভেম্বর দুপুর দুইটায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে সমাহিত করা হয়।

প্রখ্যাত এই কথা সাহিত্যিকের বিষয়ে একাডেমি পুরস্কারজয়ী বিশিষ্ট্য নাট্যজন অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, হাসান আজিজুল হক ছিলেন আমাদের এক বটবৃক্ষ স্বরূপ। তাই তাঁর চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কেননা, এইরকম ছাঁয়া দেবার মত মানুষের অভাব রয়েছে। তিনি কেবল একটি গল্প বা উপন্যাস লিখেই দায়িত্ব শেষ করেন নি।

তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরেও যত অশুভ শক্তি উত্থিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন, অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শুধু একজন কথাসাহিত্যিকই নন, তিনি একাধারে একজন দাপুটে মঞ্চ অভিনেতা, পথ প্রদর্শক এবং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রাজনীতির মাঠে এক লড়াকু যোদ্ধা বলেও জানান এ নাট্যকার।

দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা আক্তার বলেন, স্যারের মতো এতো সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ সমসাময়িক সময়ে খুব কমই দেখা যায়। কেননা, তাঁর লেখনির মধ্যে সর্বদা পারিপার্শ্বিকতার বাস্তবরূপ ফুঁটে উঠেছে। তিনি অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের জীবন সংগ্রাম ও নাগরিক সমাজের উত্থান-পতনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সাহিত্যে এক নতুন অধ্যয়ের সূচনা করেছেন। তাই বাংলা সাহিত্যে এই কথাসাহিত্যিকের অবদান অনস্বীকার্য।


সর্বশেষ সংবাদ