মান্না খানের নাসায় যোগদান, যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন
এক সংগ্রামী জ্ঞান পিপাসু নারী মান্না খান। যার স্বপ্ন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়া। বিশ্বকে নতুন কিছু উপহার দেয়া। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গড়ে উঠা অত্যাধুনিক বিশ্বকে মানুষ যখন কেবল উপভোগ করতেই ব্যস্ত, তখন খান বিশ্বকে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্ত করতে সর্বদা অক্লান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। জল সম্পদ এবং বন্যা পর্যবেক্ষণের দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্যোগ প্রশমিত করে এ অঞ্চলের ঝুঁকি কমাতে নাসায় গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। যা খানের স্বপ্ন পূরণের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
মান্না খান যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত সম্মানজনক ‘’ম্যাকনেয়ার’ স্কলারশিপপ্রাপ্ত গবেষক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ডাকোটায় (ইউএনডি) ভূগোল বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন আর্থ সিস্টেম সায়েন্স অ্যান্ড পলিসিতে (ইএসএসপি) ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জনের পথে রয়েছেন।
সম্প্রতি মান্না খান যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (নাসা) ইন্টার্ন করার সুযোগ পেয়েছেন। নাসা প্রদত্ত ভার্চুয়াল ইন্টার্নশিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ফ্রি ইন্টার্ন নয়, এজন্য তিনি সম্মানীও পাবেন। উপগ্রহ ও স্থল পরিমাপে নাসার ডাটাবেজ ব্যবহার করে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, উপকূলীয় বন্যা এবং এ সম্পর্কিত বিপদ নিয়ে গবেষণা করবেন মান্না খান।
এ উপলক্ষে মান্না খানের ইউনিভার্সিটির ব্লগে তাকে নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। ওই ফিচারে তার স্বপ্নযাত্রার কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।
২৫ বছর আগে মান্না খান পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পরে কিছু সময় ব্যবসা পরিচালনা করেছিলেন। শুরুতে ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। পরে তারা চলে যান নর্থ ডাকোটায়। ভর্তি হয়ে যান ইউএনডিতে। কিছু সময়ের জন্য মান্না খান, তার স্বামী শফিকুল এবং মেয়ে নিউজাইরা সবাই ইউএনডির বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হন। সেখানে শিগগিরই শফিকুলের পিএইচডি শেষ হতে যাচ্ছে। মেয়ে নিউজাইরা মনোবিজ্ঞানে একটি ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক শেষ করে অন্য ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাদের অভিজ্ঞতা থাকলেও ছিল না কোন ডিগ্রি। তবে সেখানে লক্ষ্য জয়ে ছিল সাশ্রয়ী অনেক সুযোগ। যেটার সর্বাধিক ব্যবহার তারা করেছেন। ইন্সট্রাক্টর ক্রিস্টোফার অ্যাটকিনসনের অধীনে ম্যাকনেয়ার প্রোগ্রামের পরামর্শ এবং সহায়তায় ইউএনডি’র ভূগোল বিভাগটি খানের কাছে পরিণত হয় দ্বিতীয় পরিবারে। পরিশ্রম আর লেগে থাকার স্বভাব দিয়ে মান্না খান সেখানে এমন পরিবেশ তৈরি করেন। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন স্বয়ং ইনস্ট্রাক্টর অ্যাটকিনসন।
কিন্তু শুরুর দিনের ইউএনডি ক্যাম্পাস তার জন্য সহজ ছিল না। সেখানে প্রতিনিয়ত সবার সাথে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নিজের সাথেও করতে হয়েছে সংগ্রাম। কারণ বাংলা ভাষাভাষী হয়ে ইংরেজি ভাষায় অধ্যবসায় তার জন্য বেশ দুঃসাধ্য লাগতো। যখন বাংলাদেশ থেকে ইউএনডি-তে প্রথম ভর্তি হন তখন তাকে ইংরেজির সাথে লড়াই করতে হয়েছিল। তার সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা এক ধন্যবাদপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার একাডেমিক যাত্রাজুড়ে আপনাদের সমস্ত সহায়তা প্রশংসা করি। আমার ড. (পল) টোডান্টারের ক্লাসে খুব কম ইংরেজি দিয়ে শুরু করেছি। ফলে একটি প্রচলিত, দ্বিভাষিক এবং প্রথম-প্রজন্মের অভিবাসী হিসাবে আমার কঠিন অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিদিন ধীরে ধীরে লার্নার হিসাবে আমাকে প্রতিটি শব্দ বাংলা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে হয়েছিল। আমি এখনও আপনাদের কাছ থেকে শিখছি। ধন্যবাদ!’
খান সম্পর্কে ইউএনডি অধ্যাপক ডগলাস মুন্সকি বলেছেন, ‘রিসাইক্লিং, ট্র্যাশ এবং টিপিং ফি এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জল এবং জল দূষণ, এবং নর্থ ডাকোটাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন মান্না খান। তিনি অনেক আঞ্চলিক এবং জাতীয় ভূগোল বিষয়ক সম্মেলনে ইউএনডির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করেছেন।’
মান্না খানের বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক ডগলাস মুনস্কি বলেছেন, ‘আমার ৪৩ বছরের অধ্যাপনাকালে খানের মতো এমন শিক্ষার্থী কম পেয়েছি। তিনি এমন কেউ যিনি বিশ্রাম নেন না। বিভাগের জন্য একটি ব্যতিক্রমী রোল মডেল তিনি!’
নিজের গবেষণা সম্পর্কে মান্না খান বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিক হিসাবে আমি আমার দুই দেশের জন্যই দায়িত্ববোধ অনুভব করি। তবে আমি ইউএনডি থেকে এবং এখন নাসা থেকে যা শিখছি তা হল দক্ষতা এবং জ্ঞান যা আমি বিশ্বব্যাপী কাজে লাগাতে চাই, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে মানুষ জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ভুগছে।’
নাসায় ইন্টার্নশিপ
খানের নাসা ইন্টার্নশিপের ইউএনডি-ভিত্তিক পরামর্শদাতা অধ্যাপক গ্রেগরি ভ্যানডবার্গ বলেন, ‘অধ্যাপক হতে খান বহু কোর্স নিয়েছিলেন এবং একাধিক ক্ষেত্রে তার সাথে কাজ করতে পেরে আমি মান্নাকে এমন কোনো ব্যক্তির মধ্যে বিকাশ করতে দেখেছি যে ভূগোল সম্পর্কে বেশ জানে। তাকে একজন দুর্দান্ত ছাত্র এবং শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক হওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দেখাটা ছিল খুবই মজাদার।’
দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজির সাথে লড়াই এবং তার বেশিরভাগ সহপাঠীদের তুলনায় বড় বয়সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির মতো বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে খান দ্রুত উত্তর দেন, ‘আমি লাজুক নই!’
ইউএনডির ব্লগে বলা হয়, মান্না খান কখনও প্রশ্ন করতে, ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছে পৌঁছানো বা উত্তরগুলি নিজেই অনুসন্ধান করতে পিছপা হননি। ইউএনডি রাইটিং ক্লাস, স্পিচ থেরাপি এবং ক্যারিয়ার সার্ভিসেসের সাথে সংযোগ স্থাপনসহ আমেরিকান ইংলিশের আরও সূক্ষ্ম বিষয়গুলি শেখার ক্ষেত্রে যেমন তার আগ্রহ ছিল তেমনি তিনি উদ্যোমী আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী।
খান বলেন, ‘আমি শিখেছি কীভাবে একটি জীবনবৃত্তান্ত, কভার লেটার লিখতে হয়। আর এসব শিখতে কোন কার্পণ্য ছাড়াই আমি মানুষের কাছে গিয়েছি। তাদের ই-মেইল করেছি। কিছু লোক জবাব দেয় না, আবার কেউ জানায়। কিন্তু আমি হতাশ না হয়ে এভাবেই অনেক লোকের সাথে সংযুক্ত হয়েছি।’
সাফল্য চেষ্টা করে যাওয়ার বিষয়
যদিও খানের ইন্টার্নশিপ গবেষণার সঠিক ক্ষেত্রটি এখনও নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে মূল ধারণাটি হল তিনি নাসা যেভাবে সময়ের সাথে সাথে দক্ষিণ এশিয়ায় জল সম্পদ এবং বন্যা পর্যবেক্ষণ করেছেন সেগুলো নথিবদ্ধ করবেন এবং তার আসন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধটি ১৯৯৭ সালের বন্যার পরবর্তী প্রভাবগুলো পরীক্ষা করবেন।
খানের উপদেষ্টা এবং সহযোগী ক্যাম্পাসের বাগানের স্থপতি অধ্যাপক রেবেকা রোমসডাহাল খানকে ‘গো-গেটর’ উপাধি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মান্না একজন দুর্দান্ত ছাত্র এবং একটি দুর্দান্ত ব্যক্তি, যাকে আমি একজন ‘গো-গেটর’ হিসেবে বর্ণনা করব। যখন সে কোনো কাজ করার জন্য মনস্থির করে, তখন সে তার পুরো শক্তি এবং আবেগ দিয়ে তা করার দিকে মনকে চালিত করে এবং লক্ষ্যে জয়ে দুর্দান্ত রেকর্ড রয়েছে তার।”