শরণার্থী শিবির থেকে মোস্ট পাওয়ারফুল ওমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস
নাদিয়া নাদিম। দুঃস্বপ্ন জীবন থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা অন্যতম এক নাম। যার শৈশবটা কেটেছে আফগান-তালেবান যুদ্ধের ভেতর, তালেবান সৈন্যদের বুলেটে তিনি হারিয়েছেন বাবাকে। একটা সময় পালিয়ে বেড়িয়েছেন পাকিস্তানের শহর থেকে শহরে। তারপর সেখান থেকে ডেনমার্কের শরণার্থী শিবিরেও। বর্তমানে নাদিয়া নাদিম হলেন বিশ্বসেরা ফুটবলার, শরনার্থী শিবিরে থাকা শিশুদের স্বপ্নের কারিগর। শূন্য থেকে শিখরে ওঠা নাদিয়া নাদিম অনুপ্রেরণা সকলের।
তিনি জন্মেছিলেন ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানে। কিন্তু বয়স ১১ না হতেই মা আর চার বোনের সঙ্গে জাল পাসপোর্ট বানিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। তালেবান সৈন্যরা মেরে ফেলেছিল তার বাবাকে। পাকিস্তান কিছুদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে পরিবারের সঙ্গে নাদিয়া পৌঁছেছিলেন ডেনমার্কের এক শরণার্থী শিবিরে, যে দেশকে তিনি এখন ঘর বলেই মানেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধ-বিগ্রহের দিনগুলো পেছনে ফেলে এসে নাদিম পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন এখানেই, আবিষ্কার করেছিলেন খেলাধুলার অবারিত দুনিয়া। অবশেষে না পাওয়া শৈশবের আনন্দটা ধরা দিয়েছিল নাদিয়ার কাছে।
ম্যানচেস্টার সিটির পর প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর জার্সি গায়ে তাকে হয়তো মাঠ মাতাতে দেখা গেছে। ২০০৯ সালে ডেনমার্কের জাতীয় দলে যোগ দেন। সেখানে শতাধিক খেলায় গোল করেছেন ২০০ এরও বেশি। প্রথম ড্যানিশ নারী ফুটবলার হিসেবে তিনি ২০১৭ সালে পণ্যদূত হয়েছেন নাইকির। এছাড়াও পণ্যদূত হয়েছেন জর্ডান, ভিসা ও হুগো বসের। তিনি শিখছেন নিত্যনতুন ভাষা, অনর্গল কথা বলতে পারেন নয়টি ভাষায়। এত সব কাজ করার পর ডাক্তারি পড়তে রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারিতে ট্রেনিং নেওয়ার সময় বের করেছেন তিনি, ফুটবল ছাড়ার পরে পুরোদমে নেমে পড়বেন ওই পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে। নাদিয়া নাদিমকে তাই কেবলই একজন ফুটবলার ভাবলে ভুল হবে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনী 'মাই স্টোরি'। বইটি মনোনীত হয় বর্ষসেরা স্পোর্টস বুক হিসেবে। ২০১৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন 'মোস্ট পাওয়ারফুল ওমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস' তালিকায় নাদিয়ার নাম ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু নাদিয়া 'অন্যতম' থেকে 'অনন্যা' হয়ে উঠছেন আরেকটি কারণে। তার বর্তমান ক্লাব পিএসজি আর ক্লাবুর (শরণার্থী শিবিরে স্পোর্টস ক্লাব তৈরি করা আমস্টারডাম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা) সঙ্গে মিলে নাদিয়া সর্বশেষ হাত দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্পোর্টস ক্লাব গড়ে তুলতে। প্রাথমিক লক্ষ্যটাও নির্ধারণ করে ফেলেছেন তারা, অন্তত ১০ হাজার শরণার্থী শিশুর কাছে খেলাধুলা নামের আনন্দময় শব্দটি পৌঁছে দেয়া।
সিএনএনের এক সাক্ষাৎকারে নাদিয়া তার জীবপ্নে ঘটে যাওয়া সেই বীভৎস দিনগুলোর স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, 'তখন কেবল একটা কথাই ভাবছিলাম, বেঁচে থাকতে হবে। "এখন কী হবে? এর পরের মুহূর্তে কী হবে? কাল সকাল পর্যন্ত কীভাবে বেঁচে থাকব!' এই প্রশ্নগুলো তাড়া করত তাকে।
নাদিয়া বলেন, টিভিতে-পত্রিকায় শরণার্থী জীবন সম্পর্কে যা জানানো হয়, পরিস্থিতি এর চেয়েও বহুগুণ ভয়াবহ। 'যে না থেকেছে, সে কখনো ওখানকার ভয়াবহতা বুঝতে পারবে না। আমার মনে হয়, ওই রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে যারা থাকে, তাদের সবারই অভিজ্ঞতা মোটামুটি এমন। ওখানে প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকার সংগ্রামে নামতে হয় আপনাকে। কেবল একটি আশাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকেন আপনি, "কাল সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে"।'
দুঃসহ অভিজ্ঞতাটা নিজের বলেই হয়তো ওইসব মানুষদের জন্য একটা কিছু করার তাড়না ছিল নাদিয়ার। ক্লাবুর জরিপ বলছে, বিশ্বজুড়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ৮০ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী, সংখ্যাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বোচ্চ। এবং এদের মাঝে প্রায় অর্ধেকই শিশু। এই শিশুদের শৈশবকে আনন্দময় করতেই পিএসজি আর ক্লাবুর সঙ্গে জুটি গড়েছেন নাদিয়া।
নাদিয়া মনে করেন, কৌতূহল শব্দ মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের জন্মগত। নতুন কিছু দেখলেই তারা নিজেরা সেটা অনুকরণের চেষ্টা করে। তাই, শরণার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠা শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই সুযোগটা করে দিতেই বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি 'ক্লাব সেন্টার' গড়ে তুলবে পিএসজি আর ক্লাবু। নাদিয়ার সঙ্গে জুটি গড়ে তাদের প্রথম প্রকল্প হতে যাচ্ছে এটাই। ক্লাব সেন্টারে খেলাধুলার যাবতীয় সরঞ্জামাদি তো মিলবেই, শিশুদের জন্য আয়োজন করা হবে ট্রেনিং সেশন থেকে শুরু করে টুর্নামেন্টও।
এই প্রকল্পটা ক্যাম্পে থাকা বাবা-মাদেরও একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলার অবকাশ করে দেবে মনে করছেন নাদিয়া। ফুটবল পায়ে সুখ ছড়িয়ে দিতে চাইছেন বাংলাদেশ থেকে কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে।
ফুটবল ক্যারিয়ারে নাদিয়া নাদিম কখনো জিতেছেন, কখনো বা হেরেছেন। কিন্তু মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-হানাহানির এ সময়টায় খুশি ফেরি করার যে সাহস দেখিয়েছেন নাদিয়া, তাই তাকে অনন্য মানুষে পরিণত করেছে।