পণ্ডিত আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী আজ
আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ স্বনামখ্যাত ইতিহাসবিদ, শিক্ষক এবং সর্বোপরি মুক্তবুদ্ধি ও উদার অসাম্প্রদায়িক এক মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। এই পণ্ডিত ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মা ইতিহাসসেবী, নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও গভীর পাণ্ডিত্য সম্পন্ন জ্ঞানতাপস আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ১৯৮৪ সালের ৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও জীবনবোধের সাহসী মানুষ আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার আলোকবর্তিকা বলা যায়। মৃত্যুবার্ষিকীর আজকের দিনে এ মহান গুণী মানুষের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। তার আত্মার চির শান্তি কামনা করছি।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জনকারী এ বি এম হবিবুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে রীডার হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৫২ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। আবু মহামেদ হবিবুল্লাহকে ঢাবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাসও ছিলেন। এর বাইরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও অধ্যাপনা করেন। দায়িত্ব পালন করেন ঢাবি কলা অনুষদের ডিন এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও।
আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর প্রধান পরিচয় তিনি একজন আকড় সন্ধানী ইতিহাসবিদ ও গবেষক। ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ ও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় শতাধিক প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও বেশ কিছু অনুবাদ ও সম্পাদনা কাজ করেছেন। তার রচিত The Foundation of Muslim Rule in India গ্রন্থটি একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ উঁচুমানের গবেষণা কর্মরূপে বোদ্ধা মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটি মূলত বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখা ১৩টি প্রবন্ধের একটি সংকলন গ্রন্থ। তার অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে আলবেরুনীর ভারতত্ত্বের কথা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের ভ্রমণকাহিনী শিগার্ফ-নামা এ বিলায়েত এর বিলায়েতনাম শিরোনামে বাংলায় আনুবাদ করেন। তিনি শিহাবউদ্দিন তালিশের ফাতহিয়া-ই-ইবরিয়া গ্রন্থের সম্পাদিত পাঠ ও অনুবাদ তৈরি করেছিলেন। তিনি Descriptive Catalogue of the Persian, Urdu and Arabic Manuscripts in the Dhaka University Library নামে দু’খণ্ডের একটি ক্যাটালগ সম্পাদনা করেন।
ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসের শিক্ষক এটিই আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর শেষ পরিচয় নয়। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন, বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তিবাদী প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিবান একজন মানুষ। ফ্যাসীবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক সরব কণ্ঠস্বর। পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার ছিল আপোষহীন অবস্থান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন স্বোচ্ছার এক প্রতিবাদী কন্ঠ। এজন্য ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার সামরিক গর্ভনর টিক্কা খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করে। এমনকি, তাকে হত্যা করারও গোপন ষড়যন্ত্র করা হয়। এ অবস্থায় জীবনের নিরাপত্তার হুমকির মুখে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য দেশ ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে চলে যেতে বাধ্য হন এবং প্রবাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফিরে এসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ছিলেন একজন সৃজনপ্রয়াসী দক্ষ সংগঠক। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস সাধনার আন্তরিক তাগিদ থেকে তিনি ১৯৬৬ সালে ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অগ্রণীদের অন্যতম। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে তাঁর মানস সন্তান বলা হয়। ঢাকা জাদুঘরের (বর্তমান জাতীয় জাদুঘর) জন্য (তিনি কয়েক বছর এর অবৈতনিক কিউরেটর ছিলেন)।