কলিগের তাৎক্ষণিক সহযোগিতায় ২০১৫ সালে বেঁচে গিয়েছিলেন শামসুর রেহমান

ড. তারেক শামসুর রেহমান
ড. তারেক শামসুর রেহমান  © ফাইল ছবি

রাজধানীতে রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের নিজ ফ্ল্যাট বাসায় থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলাম লেখক ড. তারেক শামসুর রেহমান। স্ত্রী ও কন্যা থাকেন আমেরিকায়। তিনি নিজেও সেখানেই বেশিরভাগ সময় কাটান। দেশে এলে তিনি উত্তরার এ ফ্ল্যাটেই থাকেন। হার্টে ব্লক থাকায় বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। এছাড়া আলসারের সমস্যাও ছিল তার। এ অবস্থায় প্রায় ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে একা থাকতেন। মাঝেমধ্যে আমেরিকায় মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন তিনি। সম্প্রতি যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু লকডাউনের কারণে যাওয়া সম্ভব হয় নি।

তার দেশে থাকা এবং তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকাল নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষকদের সাথে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র  কথা হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক খালিদ কুদ্দুস। তিনি ছিলেন ড. তারেক শামসুর রেহমানের সরাসরি ছাত্র এবং পরে কলিগ। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, ‘স্যার ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তার অবসরের সময় বিভাগ থেকে আমিই প্রথম তার বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। মানুষ হিসেবে তিনি খুবই ভালো ছিলেন। আমি যখন ছাত্র ছিলাম এবং ফার্স্ট ইয়ারে তখন তিনি আমার সাথে যেমন আচরণ করেছেন একদম শেষ দিকে এসেও তিনি ঠিক তেমনেই আচরণ করতেন। তিনি সবার সাথে সমান আচরণ করতেন।’ তার ক্লাসের বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘১৯৯২ সালে আমি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম এবং তিনি খুব ভালো পড়াতেন। প্রথম বর্ষে ক্লাসের যে অনুভুতিগুলো ছিলো সেটা আমি স্যারের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।’  

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লা হিল কাফি  দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তারেক শাসুর রেহমান স্যারের সাথে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো। তিনি ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন। আমি উনার আগেই ১৯৯৯ সালে যোগদান করেছিলাম। শুরু থেকেই আমি উনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আসলে উনি অসম্ভব একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমকালীন রাজনীতি নিয়ে তার লেখা বইয়ের মাধ্যমে ছাত্ররা অনেক কিছুই জানতে পারবে। উনি টকশোতেও অনেক জ্ঞানগর্বিত আলোচনা করতেন। তিনি তার জ্ঞান দ্বারা আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগকে অনেক উপরে নিয়ে গেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক উঁচু মর্যাদায় নিয়ে গেছেন।

যে রোগে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন সেই একি রোগ হয়েছিলো তার ২০১৫ সালে। আমি যখন দোতলায় ছিলাম তখন হঠাৎ শুনলাম স্যার পরে গেছেন এবং আমি দৌড়ে এসে উনাকে তাৎক্ষণিকভাবে এনাম মেডিকেলে ভর্তি করি। সেসময় আমার গাড়ির মধ্যেই তিনি অনেকবার বমি করেছিলেন, যে বমিটা তিনি তার বাসায় করেছিলেন। যেহেতু তার পরিবার আমেরিকায় থাকে তাই আমি তখন সেখানে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করি। পরে তাকে আমেরিকায় যাওয়ার জন্য বললে তিনি আমেরিকায় চলে যান। সেদিনের পরে তিনি বলেছিলেন কাফি তুমি যদি ওই মুহুর্তে আমাকে সহযোগিতা না করতে তাহলে হয়তো আমার বাঁচার সম্ভাবনা ছিলোনা। এরপর থেকে তার সাথে আমার যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো তাতে তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন আমিও তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। মাঝে মাঝেই তার খোঁজ-খবর নিতাম। তাকে বলতাম আমেরিকায় চলে যান মেয়ের কাছে থাকেন। একা একাই থাকেন কেন স্যার? এখানে তো রান্নাবান্না হয়না, কাজের বুয়া পাওয়া যায়না। আবার তিনি যেখানে বসবাস করতেন সেখানে আশেপাশে কোন বাজার ঘাট নাই। যার কারণে তার কেনাকাটা করাটা খুব কঠিন ছিলো। তার মেয়ে এবং স্ত্রী আমেরিকায় থাকেন। বাসায় একটা মাত্র কাজের বুয়া ছিলো দিনে একবার এসে রান্নাবান্না করে দিতো। এজন্য তার আসলে দিনকাল খুব কষ্টেই যাচ্ছিলো।

বিভাগের শিক্ষকদের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিলো এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এই অধ্যাপক বলেন, বিভাগের সকল শিক্ষকের সাথেই তার চমৎকার সম্পর্ক ছিলো। তিনি যেহেতু সিনিয়র ছিলেন আমরা সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করতাম। বিভাগের সকল শিক্ষকের সাথে তিনি হাসিখুশি মুখে থাকতেন এবং মজা করতেন।

কি কারণে তিনি একাই দেশে থকেতেন সে বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুল্লা হিল কাফি বলেন, দেশের প্রতি ভালাবাসার কারণেই তার মেয়ে ও স্ত্রী আমেরিকায় থাকলেও তিনি দেশেই থাকতেন। দেশের প্রতি তার অনেক ভালোবাসা ছিলো। তিনি মাঝে মধ্যেই আমাকে বলতেন যে, কাফি আসলে আমারতো উত্তরায় ফ্ল্যাট কিনেছি, বসুন্ধরায় একটা রুমও আছে এবং ব্যাংকেও কিছু টাকা পয়সা আছে। আমি এসব কি করবো? আমি তাকে বলেছিলাম এসব কিছু আপনার মেয়েকে দিয়ে যান। কারণ, আপনার মৃত্যুর পরে তো এসব ঠিক থাকবে কি থাকবেনা তা বলা মুশকিল। শেষ পর্যন্ত তো তার ব্যাংক ব্যালেন্স জায়গা জমি সব এভাবেই পরে রইলো।     

দেশের প্রবীণ গুরুত্বপূর্ণ এসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে তিনি বলেন, যারা প্রবীণ জ্ঞানী ব্যক্তি সিঙ্গেল থাকেন আর পরিবারের সব সদস্য দেশের বাইরে থাকে তাদেরকে অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায় রাখলেই মনে হয় ভালো হয়। তাহলে তার সেবাটাও পাবে আবার সেই পরিবারেরও উপকার হইলো। এই যে তার শেষ মুহূর্তে এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, তিনি পানি খাবেন কারো কাছে যে চাইবেন এমন অবস্থাও তার ছিলোনা। পরিবারের বা কাছের কেউ সাথে থাকলে তিনি একটু সহযোগিতা পেতেন অন্তত এভাবে তিনি পরে থাকতেন না।  

প্রসঙ্গত, বরেণ্য লেখক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান মারা গেছেন। শনিবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তিনি বাসায় একা ছিলেন। পুলিশ দরজা ভেঙে তাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছেন।

পুলিশ জানায়, বাথরুমের দরজার সামনে বমির ওপর পড়েছিল শামসুর রেহমানের মরদেহ। এ সময় তার পা ছিল বাথরুমের ভেতর। বাকি শরীর ছিল দরজার সামনে। তার শরীরে ছিল সাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি ও কালো রঙের প্যান্ট। আর তার ডান পায়ে ছিল মোজা। এছাড়া মরদেহের আশপাশে অনেক রক্তও দেখতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা।


সর্বশেষ সংবাদ