চেতনার মুরব্বী আল্লামা শাহ আহমদ শফী
শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রহ.) অন্যতম খলিফা আল্লামা আলহাজ শাহ আহমদ শফী। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন আলেমেদীন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর চেয়ারম্যান, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক (সদ্য সাবেক) এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে পরিচালিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর আমীর হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।
আল্লামা আহমদ শফী ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরী সনে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া থানাধীন পাখিয়ারটিলা নামক গ্রামে এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দীনদার আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মরহুম পিতার নাম জনাব বরকত আলী এবং মরহুমা মায়ের নাম মুসাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম।
পিতা-মাতা শিশুকালেই তাঁকে কোরআন শিক্ষার জন্য জনাব মৌলভী আজিজুর রহ্মান (রহ.)-এর কাছে প্রেরণ করেন এবং কোরআর শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষাও শিক্ষা দান করেন। এরপর তিনি শরফভাটা মাদরাসায় প্রাথমিক কিতাব পাঠে মনোনিবেশ করেন। ছোটবেলা থেকেই আহমদ শফী অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী ও সুবুদ্ধির অধিকারী হওয়ায় অতি অল্প বয়সেই কোরআনের তিলাওয়াত ও প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করে কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন।
এরপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামস্থ ঐতিহ্যবাহী আল জামিয়াতুল আরাবিয়া ইসলামিয়া জিরি মাদরাসায়। জিরি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সেখানে ৫/৬ মাস অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি ১৩৬১ হিজরীতে জনাব হাফেজ ইমতিয়াজ সাহেবের প্রচেষ্টায় এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামে ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর। হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করার পর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের অদম্য বাসনা নিয়ে ১৩৭১ হিজরী সনে ছুটে যান ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী হাদীস শিক্ষার পাদপীঠ, এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দীনি বিদ্যানিকেতন দারুল উলূম দেওবন্দে। উল্লেখ্য, দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই আহমদ শফী শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রহ.) হাতে বাইআত গ্রহণ করেন এবং অতি অল্প সময়েই খিলাফত প্রাপ্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
এছাড়া আহমদ শফীর শিক্ষকদের তালিকাতে উপমহাদেশ খ্যাত ইসলামী আইন বিশারদ মুফতিয়ে আজম হজরত মাওলানা ফয়যুল্লাহ (রহ.), শাইখুল হাদীস আল্লামা সুফী আবদুল কাইউম (রহ.), শাইখুল আদীব আল্লামা মুহাম্মদ আলী নিজামপুরী (রহ.) ও শাইখ আল্লামা আবুল হাসান (রহ.) প্রমুখ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেওবন্দ মাদরাসার পড়াশুনা শেষে আল্লামা মাদানির প্রতিনিধি হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন আহমদ শফী এবং চট্টগ্রামে আল্-জামিয়াতুল আহ্লিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। এরপর ১৪০৭ হিজরিতে মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। বর্তমানে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করছেন।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান তথা মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা উপমহাদেশে আল্লামা আহমদ শফীর ইলম ও প্রজ্ঞার উৎস থেকে অনুপ্রেরণা লাভকারী ছাত্র, শিষ্য, মুরীদ ও অনুসারীর সংখ্যা বর্তমানে কোটির ঘর ছড়িয়ে গেছে। তাঁর নম্রতা, খোদাভীরুতা, ইলম ও প্রজ্ঞা দেখে পবিত্র হেরেম শরীফের ইমামগণ তাঁকে শায়েখ বলে সম্বোধন করে থাকেন।
উল্লেখ্য, বিগত ১৯ আগস্ট ২০০১ইং তারিখে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে পবিত্র ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করলে হারামাইন শরীফাইনের মহাপরিচালক শাইখ সালেহ বিন আল হুমাইদ-এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তিনি আহমদ শফীকে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফের একটি অংশ হাদিয়া স্বরূপ প্রদান করে সম্মানিত করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় সীরাত কমিটি, তমদ্দুন মজলিশসহ আরো বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক আহমদ শফীকে শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব ঘোষণার বিষয়গুলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অন্যতম স্বীকৃতি।এতো দায়িত্ব ও কাজের পাশাপাশি লেখালেখিতেও রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান।
বাংলা ও উর্দু ভাষায় তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। ১. হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ২. ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ৩. ইসলাম ও রাজনীতি, ৪. ইজহারে হাক্বীক্বত বা বাস্তব দৃষ্টিতে মওদূদী মতবাদ, ৫. তাক্ফীরে মুসলিম বা মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম, ৬. সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, ৭. ধুমপান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, ৮. একটি সন্দেহের অবসান, ৯. একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া, ১০. তাবলীগ একটি অন্যতম জিহাদ, ১১. ইছমতে আম্বিয়া ও মিয়ারে হক্ব, ১২. সুন্নাত-বিদআতের সঠিক পরিচয়, এবং ১৩. বায়আতের হাক্বীক্বত, ১৪. আল বয়ানুল ফাসিল বাইনাল হক্কে ওয়াল বাতিল, ১৫. আল হুজাজুল ক্বাতিয়াহ্ লিদাফয়িন নাহ্জিল খাতেয়াহ, ১৬. আল-খায়রুল কাসীর ফী উসূলীত্ তাফ্সীর, ১৭. ইসলাম ওয়া ছিয়াছত, ১৮. ইজহারে হাক্বীক্বত, ১৯. তাক্ফীরে মুসলিম, ২০. চান্দ রাওয়েজাঁ, ২১. ফয়ূজাতে আহ্মদিয়া, ২২. বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফয়জুল জারী এবং মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রমুখ। এছাড়াও উর্দু ও বাংলা ভাষায় তাঁর আরো অনেকগুলো মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।