২৬ আগস্ট ২০২০, ১৮:৩১

ধর্মের সমালোচনা করায় বাংলাদেশি ব্লগারকে হত্যার হুমকি

আসাদ নূর  © ফাইল ফটো

ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ব্লগার আসাদ নূর একাধিকবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠন থেকে তিনি এসব হুমকি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। জীবন বাঁচাতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এই নাস্তিক ব্লগার।

আসাদ নূর জানিয়েছেন বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তার পাসপোর্ট জব্দ করেছে। ফলে কোন ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তিনি। নূর বলেন, ‘‘আমি আমার বিভিন্ন ভ্লগে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে ইসলাম এবং মহানবী মোহাম্মদের সমালোচনা করেছি। আমি রাজনৈতিক ইসলামের সমালোচক। এজন্য উগ্রবাদীরা আমার উপর ক্ষুব্ধ।’’

বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার অভিযোগ

রাঙ্গুনিয়ায় ‘বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার’ ঘটনা নিয়ে জুলাই মাসে একাধিক ভিডিও প্রকাশ করেন আসাদ নূর। তখন সেখানকার এক রাজনৈতিক নেতা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর’ অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে দেশটির বিতর্কিত ‘‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে’’ মামলা করেন।

নূর তার একটি ভ্লগে দাবি করেছেন, রাঙ্গুনিয়ার বৌদ্ধ মঠে নির্মাণাধীন একটি বৌদ্ধ মূর্তি ভেঙে ফেলেছে একদল হামলাকারী। তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি এবং সেখানকার বন কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে এই হামলা চালিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

নূর সেই ভিডিও প্রকাশের পর স্থানীয় ইসলামি বিভিন্ন গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে এবং দাবি করে যে তিনি মুসলমান এবং বৌদ্ধদের মধ্যকার ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করছেন। পুলিশ সেসময় নূরের বাড়িতে তাকে গ্রেপ্তার করতে একাধিক অভিযান চালায় এবং তাকে না পেয়ে তার পরিবারের সদস্যদের থানায় নিয়ে আটকে রাখে।

এই বিষয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত নূর বলেন, ‘‘১৮ জুলাই সকালে পুলিশ আমার বাবামা এবং পরিবারের আরো চার সদস্যকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং অবৈধভাবে ৪৮ ঘণ্টা আটকে রাখে।’’

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব-৩। তাদের একজন মুশতাক আহমেদ। এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর। অন্য আসামিদের যোগসাজশে তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন। এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’’

‘ধর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই’

রাঙ্গুনিয়ায় মূলত একটি জমি নিয়ে বৌদ্ধ মঠ এবং স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরোধ চলছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার সাবেক চেয়ারম্যান আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘‘দুই বছর আগে কোন অনুমতি ছাড়াই সরকারি জমিতে বৌদ্ধ মঠটি নির্মাণ করা হয়। সেখানকার কিছু জমি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও ব্যবহার করছেন। আসলে জমির মূল মালিক সরকার এবং কোনপক্ষকেই এই জমি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।’’

নূর জানিয়েছেন, তিনি রাঙ্গুনিয়াতে যাতে রামুর মতো পরিস্থিতি না হয় সেজন্য স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সহায়তা করেছেন। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ছবিকে কেন্দ্র করে রামুতে অন্তত চারটি বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা চালায় একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। হামলাকারীরা চারটি বৌদ্ধ মন্দির ও বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভাঙ্চুর ও জ্বালিয়ে দেয়। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, রাঙ্গুনিয়াতেও সেরকম কিছু ঘটতে পারে।

অনিশ্চিত জীবন

নূরের বিরুদ্ধে গত কয়েকবছরে বেশ কিছু ইসলামি সংগঠন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। বাংলাদেশের উগ্রপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী ‘হেফাজতে ইসলাম’ নূরের গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে।এক ইসলামী ধর্মনেতার করা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' সংক্রান্ত মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আসাদ নূরকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই মামলায় পরের বছরের আগস্ট মাসে তিনি জামিন পেলেও মাসখানেক পর মাদক সংক্রান্ত আরেক মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।

এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে সেই মামলা থেকেও জামিন পান তিনি। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তার পাসপোর্ট জব্দ করে যাতে তিনি দেশত্যাগ করতে না পারেন।

বর্তমানে ভারতে অবস্থান করলেও প্রতিনিয়তই হত্যার হুমকি পাচ্ছেন নূর। তিনি জানান, অতীতে ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করা একাধিক ব্লগারকে বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘যদিও ব্লগারদের ধারাবাহিকভাবে হত্যা করার যে ধারা শুরু হয়েছিল তা এখন বন্ধ আছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ ব্লগারদের জন্য এক নিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে। এরকম হত্যাকাণ্ড যে আবার শুরু হবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিচ্ছে না’’।

ভারতেও গ্রেপ্তার

গত বছর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তিনমাস পর অবৈধভাবে বিনা পাসপোর্টে সেদেশে অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার হন আসাদ নূর। এরপর ছয়মাস ভারতের কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ভারতের আদালতে তার মামলা চলছে। তবে করোনার কারণে সেটির শুনানির তারিখ পিছিয়ে গেছে।

প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ নূরের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে এবং তার পাসপোর্ট তাকে ফিরিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটির প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২১ জুলাই এক বিবৃতিতে নূরের পরিবারকে হেনস্থা না করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি বিবৃতিতে লিখেছে, ‘‘মানবাধিকার রক্ষাকারীরা যাতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুক্তভাবে এবং নির্ভয়ে চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।’’ [সূত্র: ডয়চে ভেলে]