অন্তিম শয্যাতেও কবিতা লিখতে ইশারায় কাগজ-কলম চাইতেন
কবি শামসুর রাহমান যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এ যুগ স্বভাব কবির নয়, স্বাভাবিক কবির। জীবনানন্দ পেয়েছিলেন সরল প্রকৃতি থেকে ইন্দ্রিয়ঘন প্রকৃতির রং-রূপের সন্ধান, সুধীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ঈশ্বরহীন পৃথিবী, বুদ্ধদেব বসু পেয়েছিলেন প্রেম ও আঁধারকে, শামসুর রাহমান পেলেন নগরজীবনকে। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের আজ ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ।
সংগ্রামী চেতনায় ধারণ করলেন শহরের প্রতিচ্ছবি এবং হয়ে উঠলেন প্রকৃত অর্থেই ‘নাগরিক কবি’। বিরূপ বিশ্বের নাগরিক হিসেবেও তিনি সচেতন। তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয় সমকালীন বর্বরতা ও হিংস্রতার চিৎকার। আধুনিক কবিতার সাথে কবি শামসুর রাহমানের পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯-এ।
‘শামসুর রাহমান: আমাদের হৃদয়ের কবি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে কবি এবং কথাসাহিত্যিক কাজী জহিরুল ইসলাম লেখেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে / সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ কবি শামসুর রাহমান সেই সহজ কথার, সহজ শব্দাবলির এক দক্ষ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন খুব কম বয়সেই। অত্যন্ত সহজ শব্দাবলিতে তিনি অবিরাম পয়ার রচনার এক দুর্লভ কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিলেন। তাঁকে যতবার, যে অবস্থাতেই দেখেছি সব সময়ই মনে হয়েছে তিনি একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে আছেন। সেই ঘোর কবিতার ঘোর। কবিতা-ই ছিল তাঁর চৈতন্যের ঘর-বাড়ি। তাঁকে কখনোই কবি ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু মনে হয়নি। যখনই দেখি মনে হয় তিনি সেই অমিয় ঘোরের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কাব্যদেবী তার রেশমি শুভ্র চুলে বিলি কাটছে। তিনি এক্ষুনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়বেন। বাংলা সাহিত্যে যোগ হবে আরও একটি অসাধারণ কবিতা। তাঁর চিন্তার বাগানে কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনো স্বপ্নের বীজ প্রোথিত হয়নি।
তার অন্তিম ইচ্ছাটিও এটিই ছিল। আরও একটি পঙ্ক্তি রচনার ইচ্ছা। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি মাঝে-মাঝেই অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলতে চাইতেন। ইশারায় কাগজ-কলম চাইতেন রোগশয্যাপাশে শুশ্রূষারত প্রিয়জনদের কাছে কবিতা লেখার জন্য।
শুধু কবিতায়ই নয় সাহিত্যের অন্যসব ক্ষেত্রেও তাঁর লেখায় রয়েছে বহুমাত্রিকতার ছাপ। ৬৬টি কাব্যগ্রন্থ, চারটি উপন্যাস, প্রচুর প্রবন্ধ, ছড়াসহ তাঁর শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে নয়, তাঁর রচনাসমগ্র গুণেমানেও অনন্য। এসব রচনার জন্য বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তিনিই ঢাকার কল্যাণপুরে তাঁর নিজ বাসায় সস্ত্রীক জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন। পরে দুজনেরই সাহসী প্রতিরোধে সেদিন তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা সর্বদাই জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদবিরোধী ছিলেন।
তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে মুদ্রিত হয়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছদ্মনাম নিয়েছেন। যার মধ্যে ছিল- সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক অন্যতম। শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা।
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।
১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহিদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন ‘আসুন আমরা আজও একজন জেলে’ নামক কবিতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।
শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।
কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুপূর্ব ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, মায়ের কবরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ কবি শামসুর রাহমান পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদকসহ দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার সম্মাননা। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হতে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি উপাধি দিয়েছেন। গুণী এই কবির কর্মমুখর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।