শিক্ষক থেকে জনপ্রিয় উপস্থাপক, পেয়েছিলেন নায়ক হওয়ার প্রস্তাবও
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। যিনি প্রতিনিয়ত মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে চলছেন। মানুষ যখন তীব্র হতাশা ও স্থবিরতা মধ্যে বিরাজ করে। সেই মুহূর্তে তিনি শোনান আশা ও সম্ভাবনার কথা। তিনি একজন অসাধারণ বক্তা। ১৯৭০ দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আর ষাটের দশকে পেয়েছিলেন নায়ক হওয়ারও প্রস্তাব। এসব ছেড়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চল্লিশ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
আজ ২৫ জুলাই। শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮১তম শুভ জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের আজকের এই দিনে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর নিজের ইউটিউবে চ্যানেলে জীবন বদলে দেওয়ার গল্প নামক একটি ভিডিও আপলোড করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের কাছে উনার বলা গল্পটি তুলে ধরা হলো—
ভিডিওতে তিনি বলছেন, আমি ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলাম, তখন ঢাকা কলেজের অনেক সুমান ছিলো। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েও এই কলেজের ভর্তি হতে পারতো না। আমি বলতাম মানুষকে আমাদের এখানে এক সেকশনে যে মেধাবি শিক্ষার্থী আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন শিক্ষার্থী নেই। ঢাকা কলেজে কিন্তু মেয়েরা পড়ে না। যা আমাদের ছাত্রদের জন্য মর্মবেদনার কারণ ছিলো। দুপুরে হলেই মধ্যাহ্নভোজ নয় মধ্যাহ্নভ্রমণের জন্য বের হতো নিউ মাকের্টে। কারণ ওখানে সুন্দরী মেয়েরা বাজার করতে আসতো।
একদিন ক্লাসে আমি জানতে চাইলাম। তোমাদের মধ্যে কে কে শিক্ষক হতে চাও। তার আগে আমি শিক্ষকদের গুরুত্ব ছাত্রদের কাছে তুলে ধরলাম। বললাম, আমরা যারা শিক্ষক তারা কাউকে স্যার বলি না। কিন্তু ক্লাসে কোন শিক্ষার্থী শিক্ষক হতে চাইলো না। পরে যখন আমি বললাম, তোমরা কে কে প্রকৌশলী হতে চাও। তখন ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী হাত তুললো। আমি তখন জানতে চাইলাম কে তোমরা শিক্ষক হতে চাও না। বেতন তো সমান।
তখন একজন শিক্ষার্থী বলে উঠলো, বেতন তো সমান কিন্তু আয় তো সময় না। আমি তাদের বললাম, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। সুতরাং শিক্ষকতা পেশায় শিক্ষার্থীদের আনতে হলে অন্যান্য পেশার থেকে আয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে কেউ শিক্ষক হতে চাই না।
তবে জাতির জন্য শিক্ষক কত বড় মাপের মানুষ একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবে। আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিলো, আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করবো। আমি আমার জীবনে অনেক বড় মাপের শিক্ষক পেয়েছি। একজন অধ্যাপক পেয়েছিলাম অসাধারণ। তিনি ক্লাস নেওয়ার সময় সমন্ত পৃথীবিকে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন।
মনে হতো সেই পৃথীবিতে শিক্ষক পাগলের মতো ছুটতে থাকতো। আমরাও তার সঙ্গে ছুটতে থাকতাম। হাঠাৎ দেখতাম ঘন্টা বেজে উঠতো। আমাদের মনে হতো ক্লাসের টাইম শেষ না হতেই ঘন্টা পড়ে গেছে। এই অধ্যাপকের ক্লাসের কারণ আমার মাথা থেকে সাহিত্যের ভূত পালিয়ে গিয়েছিলো। মনে চিন্তা বাসা বাঁধছিলো, যদি পড়াশুনা করতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতেই পড়বো।
তবে ৬ মাস পার না হতেই সেই শিক্ষক কলকাতায় চলে গেলো। আমাদের এখানে নতুন শিক্ষক আসলো। সেই শিক্ষক এতোটায় খারাপ ছিলো যে, আমি আবার সিদ্ধান্ত নিলাম যদি বিষয় পড়তে না হয়— সেটা হলো অর্থনীতি। তাহলে দেখেন একজন শিক্ষক কি মূল্যবান দেখেন।
সেই শিক্ষক যদি থাকতো তাহলে আজ আমি অর্থনীতিবিদ হতাম। একজন শিক্ষক যদি বড় হলে সমন্ত জাতি যুগ যুগান্তর বড় হয়ে যায়। এ কারণে শিক্ষকতা পেশা মহত। একবার শিক্ষক হলে আজীবন শিক্ষক থেকে যায়। একবার ছাত্র হলে চিরদিনের জন্য ছাত্র হয়ে থাকে। শিক্ষকতা কোন পেশা না। এটা হলো মহৎ পেশা।
একটি ছোট গল্প বললে আরও পরিষ্কার হবে এটা যে মহান পেশা। এরশাদের আমলে সাময়িক শাসন জারি হয়েছে। তার সাথে আবার ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু চলছিলো। সেই সময় ধানমন্ডি থেকে আমি গাড়ি নিয়ে আসবো বাংলামোটর। তবে আমার গাড়ী ইসুরেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। তো গাড়ী ধরলে তো অপমানের শেষ নাই। মনে মনে চিন্তা হচ্ছিল যদি ধরে ফেলে। চিন্তা পড়ে গেলাম। ভাবলাম সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফার্মগেটের ভিতর দিয়ে ডুকবো। তবে ফার্মগেটের দিকে গিয়ে চোখে পড়ল পুলিশ। শুধু তাই না সার্জেন্টও দাঁড়িয়ে আছে।
আমার গাড়ীটি ফার্মগেট পৌচ্ছানো মাত্রাই ট্রাফিকের লাল আলোটি জ্বলে উঠলো। মনে মনে ভাবছি আমি শেষ। আস্তে আস্তে সার্জেন্ট আমার দিকে আসতে থাকে। আমি তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। গাড়ী থেকে মুখ বাহির করে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। আর বুকের মধ্যে কাঁপা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে সার্জেন্ট আমাকে ধরে ফেলবে। যখন সার্জেন্ট আমার কাছে আসলে মূহুর্তের মধ্যে এক বিপ্লব ঘটে গেলো।
যখনই আমার চোখে তার চোখ পড়লো। তখন সে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো আসসালামু আলাইকুম স্যার, বলেই একদম জড়ষড় হয়ে পড়লো। তার সব ডাট, পাট, ভাব একবারে কাদামাটিতে পড়ে গেলো। কারণ সে যেদিন তার গ্রাম থেকে আসছিলো আমরা তার কাছে অনেক বড় নায়ক ছিলাম। আর আমরা ছাত্র দেখলে চিনতে পারি তার কথা বলা দাঁড়ানো দেখলেই চিনতে পারি। তো শিক্ষক ছাত্রের ব্যাপারটা এমনই। শিক্ষকের বেতন কম হলেও তাদের সর্ম্পকে জায়গাটা অনেক প্রসার।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষকতার কারণেই ষাটের দশকে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব। এক জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘টেলিভিশনের এক ভদ্রলোক একটা চলচ্চিত্র বানাবেন। আমাকে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের নায়ক করতে চাইলেন। তখন আমি ঢাকা কলেজে পড়াই। তাঁকে বললাম, “আমি শিক্ষক মানুষ, চারিদিকে আমার এত ছাত্র, আমি কীভাবে নায়ক হব? নায়িকার হাত ধরে সমুদ্রের পারে, পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটব? এটা আমি পারব না।” আমি জাহানারা ইমামের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি ছিলেন খুব আধুনিক মানুষ। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “আপনি তো আধুনিক শিক্ষক, আপনি এটা করতেই পারেন। শিক্ষক মানে যে “‘দেবতা”’ হয়ে সন্ন্যাস নিয়ে থাকা, তা তো নয়।” তাঁকে বললাম, “শিক্ষককে ছাত্রদের কাছে দেবতা হতে হয় না, তবে দেবতার মতো কিছু একটা হতে হয় বৈকি। না হলে আমরা কাদের দ্বারা প্রভাবিত হব? শিক্ষক দেবতা হোক আর না হোক, তার মাঝে বড় কিছুর অনুভব থাকা চাই।”
‘শেষ অবধি ওই পরিচালক ভদ্রলোক আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন, চরিত্রটা কতটা নিরাপরাধ, বিলাতফেরত ডাক্তার, এমন কোনো বিব্রতকর দৃশ্য নেই। কিন্তু আমি আর করিনি। আমাদের সময়ের খুব বড় একজন নায়ক ওই চরিত্র করেছিলেন। সিনেমা হলের সামনে নায়ক–নায়িকাদের বড় ছবি টানানো হলো, কাটআউট বসানো হলো। দেখা গেল, সেই নিরপরাধ, নিষ্পাপ নায়ক নায়িকাকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভাবলাম, হায়রে, এটাই যদি আমি করতাম, তাহলে আজ কী হতো! আজও আমার মনে হয়, ঠিক সিদ্ধান্তই আমি নিয়েছিলাম। কারণ, জীবনে এত বৈপরীত্য থাকলে মুশকিল।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৪ সালে তিনি রোমেন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরবর্তী সময়ে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালে রাজশাহী কলেজ প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি সরকারি চাকরিজীবন শুরু করেন। এরপর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ও ঢাকা কলেজেও শিক্ষকতা করেন। দেশে পাঠাগারের অপ্রতুলতা অনুধাবন করে তিনি ১৯৯৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু করেন।