পাঠ্যবইয়ে ছোট হয়ে আসছে তাজউদ্দিন আহমদের পরিচিতি
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। একাধারে ছিলেন আইনজীবী, রাজনীতিবিদও। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করেছিলেন রাজনীতি। পরে দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছিলেন অগ্র সৈনিক। তার অবদান তাই এদেশে চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতার এত বছর পর এসেও একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশের মানুষ তার কাছে চির ঋণী।
আজ এই মহান ব্যক্তির ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। তাজউদ্দিন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান। মাতা মেহেরুন্নেসা খানম। তিনি ১৯৪৪ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৮ সালে আই.এ পাস করে। পরে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়ে আইনব্যবসা শুরু করেন।
তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখেন। অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী তাজউদ্দিন আহমদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনের সব পর্যায়ে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।
গত বছর একটি গণমাধ্যমের নিবন্ধে তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ অনেকটা অভিযোগের সুরে লিখেছিলেন, ‘স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পাঠ্যবই বিতরণ অনুষ্ঠানে যখন যোগদান করি, তখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে চোখ বুলাই। বইগুলোতে তাঁর জীবনী চোখে পড়েনি, তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে সংক্ষেপে। উদাহরণস্বরূপ ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের মাত্র অর্ধ প্যারার একটি লাইনে যুক্ত হয়েছে শুধু তাঁর নাম ও পদবিটি।’
তিনি লেখেন, ‘ওই ন্যূনতম উল্লেখ থেকে আজকের শিশু–কিশোর, তরুণ প্রজন্ম জানবে না বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অসামান্য অবদান ও সাফল্যের কথা। তারা জানবে না তাজউদ্দীন আহমদের সুদক্ষ, সাহসী, দূরদর্শী ও স্বাধীনতার প্রতি আপসহীন নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হতো না।’
তিনি আরো লেখেন, ‘স্বাধীন দেশের মাটিতে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও সসম্মানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না, যদি না সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের হাল না ধরতেন। একজনকে বাদ দিয়ে অপরজনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।’
ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ সক্রিয় হন রাজনীতিতে। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হন। ভাষা আন্দোলন, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সকল আন্দোলনে সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। এছাড়া তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি গ্রেফতার হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য তিনি। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি ৯২-ক ধারায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে তাজউদ্দিন আহমদ গ্রেফতার হন। ১৯৫৯ সালে মুক্তিলাভ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন।
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরই এপ্রিলে তিনি গ্রেফতার হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (১৯৬৫) সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছয়দফা আন্দোলনের সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে দলের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহূত গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
শারমিন আহমদ অপর একটি নিবন্ধে লেখেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে, তাজউদ্দীন আহমদ, এক নির্মোহ সাধকের অধ্যবসায় নিয়ে সেই প্রেরণা এক সাফল্যমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করেন।’
তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যদি এক বাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে হয় তাহলে বলা যায়, তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত প্রকৃতির ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজেকে আড়ালে রেখেও কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে বিশাল মাপের কাজগুলি অসাধারণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যেমন করে সম্পন্ন করতেন তার জুড়ি মেলা ভার।’
পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তাজউদ্দিন আহমদ অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি কয়েকজন সহকর্মীসহ ভারত গমন করেন। ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভেতিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তাজউদ্দিন আহমদ প্রথমে অর্থ এবং পরে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পদত্যাগ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তাজউদ্দিন আহমদ গৃহবন্দী হন। পরে ২২ আগস্ট তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। বন্দি অবস্থায় ৩ নভেম্বর অপর তিন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং মোহাম্মদ মনসুর আলীর সঙ্গে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এবং নিজস্ব প্রয়োজনেই একদিন খুঁজে নেবে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে। পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত দু–একটি শব্দের ঘের ও রাষ্ট্রে তাঁর অতিক্ষুদ্র পরিসরে অবস্থানের গণ্ডি পেরিয়ে, কেউ যদি তাঁর বিশালত্ব খুঁজতে চান, তাঁরা তাঁকে খুঁজে পাবেন বাংলাদেশের মানচিত্রে, পতাকায়, নদী-অরণ্যে, নিষ্পেষিত জনতার অটল বিদ্রোহে, শ্রান্ত মজুরের ক্লান্তি উপশমে, আর ওই বিপন্ন বালিকার ভরসার স্থলে। তাঁকে খুঁজতে গেলেই বাংলাদেশ খুঁজে পাবে নিজেকে।’