৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছরই উদ্যোক্তা ছিলেন
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ। মাত্র ৩৩ বছরে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেলে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনি। তার লিংকডইন প্রোফাইল বলছে, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রযুক্তি উদ্যোগের উদাহরণ টানতে গেলে সবার আগে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের নাম আসে। বিশ্বজুড়ে এ কোম্পানি বেশ পরিচিতিও পেয়েছে। এরই সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাহিম সালেহ।
ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে পেশাদার খুনীর দল তাকে খুন করেছে। পুলিশ এখনো খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায়নি। তবে ধারণা করছে, পেশাদার খুনি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফাহিম সালেহর শরীরের বিভিন্ন অংশ অ্যাপার্টমেন্টে ছড়ানো–ছিটানো ছিল এবং কিছু অংশ একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
ফাহিমের বাবা এবং মা দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশী। ফাহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে। তার জন্মের পরে সৌদি আবর থেকে তাদের পরিবার আমেরিকা চলে গিয়েছিল, ফাহিমের শৈশব-কৈশোরের সবটাই তাই আমেরিকাতেই কেটেছে। স্কুল এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া অত্যন্ত সফলতার সাথে শেষ করে তিনি বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর থেকে চাকরি খুঁজছিলেন। নিউইয়র্কের পাশাপাশি তিনি বোস্টনের বিভিন্ন কোম্পানিতেও চাকরির আবেদন করেন। ওই সময় তিনি চাকরিও পেয়ে যান।
কিন্তু জন্ম থেকে নিউইয়র্কের সাথে অন্যরকমের এক মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া ফাহিম বিশ্বের নিউইয়র্ক শহর ছাড়তে চাননি। তাই বোস্টনের খ্যাতনামা একটি কোম্পানির অ্যাপয়নমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পর যোগদান করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি তৈরি করেন প্রাংক ডায়াল ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইটটি খুবই অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে।
কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস ফাহিম সালেহ স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ করেন তিনি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফাহিম। ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে। ২০১৫ সালে যখন বাইক রাইড শেয়ারিং নিয়ে কারো তেমন কোন ধারণাই ছিল না, তখন মাত্র ১০০টি বাইক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল পাঠাও। সেই পাঠাও এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাইড শেয়ারিং কোম্পানী, প্রায় ১ লক্ষ রাইডার কাজ করেন পাঠাওয়ে, প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এই কোম্পানি মূল্যমান, কয়েক'শ কোটি ইনভেস্টমেন্ট। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পাঠাওয়ের আগমনের কারণে অজস্র মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছে। বেকার যুবকরা রাউড শেয়ারিংয়ে নাম লিখিয়েছে, মোটর সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে পাঠাও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ফাহিম সালেহর সাথে আরো দুজন ছিলেন। যাদের কাছে পরবর্তী সময়ে ফাহিম সালেহ তার কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যান। তবে থেমে থাকেননি তিনি। এরপর ‘পাঠাও’-এর আদলে অন্য দেশে ব্যবসা প্রসারের চিন্তাভাবনা শুরু করেন ৩৩ বছর বয়সী এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও, নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া ও আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নাইজেরিয়ায় চালু করা ওকাডা ওই দেশের বর্তমান সময়কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং এ্যাপ। অত্যন্ত মেধাবী ফাহিম সালেহর স্বপ্ন ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপসকে ভিন্নমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। তার আশা ছিল ইন্দোনেশিয়ার ওজেকের মতো পাঠাও’ও একদিন দারুণ এক সুপার অ্যাপে পরিণত হবে। শুধু রাইড শেয়ারিংই নয়, পেমেন্ট এবং ই-কর্মাসও করা যাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। এজন্য নানাভাবে কাজ করছিলেন তিনি। অ্যাপসের মানোন্নয়নে রাতে দিনে পরিশ্রম করছিলেন। নিউইয়র্ক শহরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফাহিম সালেহ।
টেককাবাল নামে নাইজেরিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই গোকাডা ৫৩ লাখ ডলার আয় করে। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গোকাডা পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে। বর্তমানে নাইজেরিয়ার রাজধানী লেগোসে তাদের ১০০০ মোটরসাইকেল রয়েছে। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইনের খবরে ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়ার প্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে নাইজেরিয়ার গোকাডার পাশাপাশি পিকআপ নামে কলম্বিয়ার আরেকটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিরও তিনি অংশীদার। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গোকাডা বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়লে গত বছরের শেষ দিকে ফাহিম কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরনের ব্যবসায় তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।
কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস তাঁর স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। ২০১৭ সালে গোকাডা চালুর পর গত বছরের জুনে ৫৩ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি সেবা আরও বাড়াতে চেয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে আরও তহবিল পায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার এ সেবা বন্ধ করে দেয়।
তাঁর লিঙ্কডইন প্রোফাইলে দেখা যায়, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিনিয়োগ করেন তিনি।