১৩ জুলাই ২০২০, ১৪:৪১

ইব্রাহিম নাম বদলে কেন শহীদুল্লাহ রাখলেন?

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ  © টিডিসি ফটো

বাংলা ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষায় যে মহৎ প্রাণের অধিকারী ব্যক্তিগণ তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন এবং অসামান্য অবদান রেখেছেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র আট দশক বয়সের জীবনে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদান এবং কর্মপরিধি গণনা করে শেষ করা যাবে না।

যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, অনুবাদক, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, দার্শনিক, জ্ঞানতাপস ও ভাষা সৈনিক হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। বিশেষ করে, তার উদার মনোভাবের জন্য সকল ধর্মের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’, তার এ বাণীই প্রমাণ করে যে, বাঙালি জাতির প্রতি তার কত ভালবাসা এবং তিনি কতটা মহৎ, দেশপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব।

তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ইংরেজি, ল্যাটিন, আরবি, উর্দু, ফারসি, জার্মানি, ফরাসি, হিব্রু, গ্রীক, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, সিংহলী ও সিন্ধীসহ প্রায় ২৪ টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে ১৮টি ভাষাতেই অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিলো এবং সেই ভাষাগুলোতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। আর বলা যায়, বাংলা ভাষার এক ধরনের পোস্টমর্টেমই তার দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। কোটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন এই বাংলা ভাষায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কৃতিত্ব যেন ভুলার মত নয়।

চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া নামে পরিচিত এই মহান মনীষীর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। পিতা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরীফের খাদেম। আর মাতার নাম হুরুন্নেসা। তিনিই ড. শহীদল্লাহর প্রথম নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম থেকে বদলে রাখেন শহীদুল্লাহ। কারণ তার ধারণা হল যে, শহীদে কারবালার চাঁদে তার ছেলে গর্ভে এসেছে এজন্য নাম শহীদুল্লাহ রাখলেই ভালো হবে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন গ্রামের এক মক্তব থেকে। তিনি মীর মশাররফ হোসেনসহ বেশকিছু লেখকের শিশুপাঠ্য বইসমূহ মক্তবেই পড়েছিলেন। মক্তবের বাইরে অন্যান্য শিক্ষা তিনি প্রাপ্ত বয়সে শুরু করেছিলেন।

মক্তবের পড়া শেষ করে তিনি হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। তখন থেকেই তার ভাষা শেখার আকাঙ্ক্ষা জন্মে। স্কুলে থাকতেই তিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি ও উড়িয়া শিখেছিলেন। এমনকি গ্রিক ভাষাও শেখা শুরু করেছিলেন। মূলত ভাষা শেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার স্কুলের শিক্ষক, আচার্য হরিনাথ দে এর কাছ থেকে।

ঢাবি শিক্ষার্থী মোঃ জাফর আলী

 

১৯০৪ সালে তিনি হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৬ সালে এফ এ পাশ করেন। ১৯১০ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত নিয়ে এম এ ডিগ্রি করতে চাইলে ওই বিভাগের এক অধ্যাপক মুসলিম ছাত্রকে সংস্কৃত পড়াতে অস্বীকার করেন। এজন্য একধরনের বাধ্য হয়েই তিনি ভাষাতত্ত্ব নিয়েই পড়ার চিন্তা করেন।

১৯১৩ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর সহযোগিতায় জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার বৃদ্ধি পেলে স্বাস্থ্যজনিত কাগজপত্রের জন্য তার আর বিদেশ যাওয়া হয় না। ১৯১৪ সালে বি এল পাস করে, ১৯১৫ সালে তিনি সীতাকুন্ড হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

তাছাড়া ১৯১১ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব, ১৯১৭ সালে নির্বাচিত সভাপতি ও শেষমেশ ১৯২১ সাল পর্যন্ত যুগ্ম সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯১৫ সালের পর নিজ এলাকায় আইন ব্যবসা শুরু করলে অল্প সময়েই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন শহীদুল্লাহ।

১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে একটি গবেষণার কাজ করেন এবং এসময় বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে লেখা তার কিছু প্রবন্ধ একটি জার্নালে প্রকাশিত হলে শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীও সেগুলো দেখে অনেক সন্তুষ্ট হন এবং শহীদুল্লাহকে উৎসাহ প্রদান করেন। এজন্যই ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাকেই উৎসর্গ করেছেন।

পরবর্তীতে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল। প্রতিষ্ঠার শুরুতেই তিনি এখানে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পাশাপাশি তিনি দুই বছর আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেছেন। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালেই প্রমাণ করেন যে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে।

১৯২৬ সালে তিনি ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ফ্রান্সে গমন করেন এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, বৈদিক ও প্রাকৃত ভাষার ওপর পড়াশোনা করেন এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছেন তিনি। পরবর্তীতে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে গবেষণার জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে, দেশে ফিরে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। সংস্কৃত ও বাংলা ভেঙ্গে আলাদা আলাদা বিভাগ হলে ১৯৩৭ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৪ সালে অবসর প্রাপ্ত হন।

ভাষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তার সম্মানার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল।

 

অবসর গ্রহণের পরেই তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯৪৮ সালে তিনি আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (ফার্সি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তাছাড়াও তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে তিন বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৭ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

তিনি শুধু শিক্ষকতার মাধ্যমেই জীবন অতিবাহিত করেননি বরং বহুমুখী ও নানা কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে সর্বদা যুক্ত রেখেছেন। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, করাচি উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু উন্নয়ন প্রকল্প’, বাংলা একাডেমির ‘পূর্ব পাকিস্তানী ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ ও ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

এছাড়া তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক, ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোষ্ট, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য, বাংলা একাডেমির বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।

তাছাড়াও তিনি ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, ১৯২৮ সালে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, ১৯৪১ সালে হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্য বিদ্যা সম্মেলন ও ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সম্মানিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর সম্পাদনায় বহু পত্রিকা তাদের লেখনী প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে আল-ইসলাম পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, আঙ্গুর, দি পীস, তকবীর (পাক্ষিক পত্রিকা) ও বঙ্গভূমি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত, ‘ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহঃ জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক এক প্রবন্ধের তথ্য অনুযায়ী তার গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০ টি। তিনি ৪১ টি পাঠ্যবইও লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তার লিখিত প্রবন্ধ রয়েছে ৬০ টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের ওপর তার ৩৭ টি রচনা রয়েছে। তাছাড়া তিনি ৩ টি ছোট গল্প এবং ২৯ টি কবিতাও লিখেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অসামান্য কাজ করেছিলেন সেটি হল, বাংলা একাডেমী থেকে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান বের করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, অমিয় শতক ও দীওয়ানে হাফিজসহ তার ১১ টি অনুবাদ গ্রন্থ রয়েছে তার। তার লিখিত বিখ্যাত তিনটি শিশুতোষ গ্রন্থ রয়েছে। আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও বাংলা সাহিত্যের কথা (দ্বিতীয় খন্ড) ইত্যাদি।

তার সারা জীবনের অসাধারণ সব কৃতিত্বের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য উপাধি, পদক ও পুরস্কার। তার মধ্যকার ফ্রান্স সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত ‘নাইট অফ দি অর্ডার অব আর্টস এন্ড লেটার্স’ উপাধি, ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ কর্তৃক ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধি, ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স পদক (১৯৫৮)’, মরণোত্তর ‘হেলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মরণোত্তর ‘ডি লিট’ উপাধি, ১৯৮০ সালে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল তাকে সম্মানিত ফেলো হিসেবে মনোনীত করলে পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি।

পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পশতু, পাঞ্জাবি, বেলুচি ও সিন্ধী ভাষা থাকা সত্ত্বেও এবং পুরো পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও পাকিস্তানি শাসকগন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে, সর্বপ্রথম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এর কঠোর প্রতিবাদ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন সেমিনার ও সভা-সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগদানকৃত ছাত্রজনতাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেইট ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ড. শহীদুল্লাহ অনেক ব্যথিত হৃদয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলেন এবং তার কালো আচকান কেটে বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, "দেশে একটি রাষ্ট্রভাষা হলে সে সম্মান বাংলার, দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলার সঙ্গে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে"। এভাবে তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

প্রতিটি ভাষার প্রতিই তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। বিশেষ করে, মাতৃভাষা বাংলার প্রতি। এজন্যই তিনি বলেছিলেন, ‘যে জাতি তার ভাষাকে শ্রদ্ধা করে না সে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়’। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই, এই মহান মনীষী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। শহীদুল্লাহ্ হলের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তার সম্মানার্থে, ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সমাধি

 

২০০৪ সালে, বিবিসি বাংলা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?’ এই বিষয়ের উপর শ্রোতা জরিপের আয়োজন করেছিল। দীর্ঘ ৩০ দিনের চালানো শ্রোতা জরিপে ২০ জন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পান।

জনপ্রিয় এই মহান মনীষী শুধু বাংলায় নয়, বরং পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণে ও বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশে তার ছোট্ট জীবনে যে অতুলনীয় ভূমিকা রেখে গেছেন সে জন্য আজীবনই সর্বস্তরের মানুষের নিকট চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একজন শহীদুল্লাহর জীবনে দেশ ও জাতির কল্যাণে এত কাজ সম্পন্ন হয়েছে যে, সেগুলোর সবই তুলে ধরা সম্ভব নয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বৃহৎ এই কর্মপরিধিই প্রমাণ করে যে, তিনি আসলেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

শিক্ষার্থী: শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়