মহাকালের আনিসুজ্জামানের এককাল
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৪ মে ২০২০, ০৫:৩৫ PM , আপডেট: ১৪ মে ২০২০, ০৬:২৬ PM
দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপকও। এছাড়া একাধারে ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষাসংগ্রামী, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী। ছিলেন দেশের সংবিধানের অনুবাদকও।
দেশের প্রায় সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে। তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
বিরল প্রতিভার অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান আমাদের মাঝে আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজ বৃহস্পতিবার (১৪ মে) বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দেশের খ্যাতিমান এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে। ২০১৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে সম্মানসূচক ‘পদ্মভূষণ’ গ্রহণ করেন তিনি।
বিরল প্রতিভার অধিকারী আনিসুজ্জামানের বাবা ডা. এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী, লেখালেখিতেও অভ্যাস ছিল। দাদা শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ১৮৮৮ সালে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী লেখেন। তা ছিল কোনো বাঙালি মুসলমানের লেখা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম জীবনী।
নিজের দাদা ও তৎকালীন মুসলিম সমাজ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আমার দাদা শেখ আবদুর রহিম উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথমে গ্রন্থকার ও সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বাংলায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী লেখেন। আমার দাদা যখন সাংবাদিকতা করেছেন, তখন এক ধরনের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন।’
ছোটবেলা থেকেই সাধারণ জীবন যাপনকারী আনিসুজ্জামান মানুষের পাশে দাঁড়াতে কখনো পিছপা হননি। দেশ ও জাতির সংকটে এবং সম্ভাবনায়ও এগিয়ে এসেছেন তিনি। অত্যন্ত পরিশ্রমী আনিসুজ্জামানের লেখনী ও কথাবার্তায় ছিলেন পরিমিত ও আকর্ষণীয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৬২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো হিসেবে বৃত্তি পান। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন।
এছাড়া তরুণ বয়সে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ ছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। নিজের সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি বন্ধু ও আড্ডাপ্রিয় মানুষ। যেটুকু কাজ করতে পেরেছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কম নয়।’
গবেষক ও চিন্তক হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ষাটের দশকে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারার স্বরূপ উন্মোচন করে রচনা করেছেন অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। পেশা শিক্ষকতা হলেও প্রকৃত নেশা লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর লেখা অসামান্য গ্রন্থ।
দেশে রবীন্দ্র চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনিই। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে ‘মুসলিম বাংলার সমসাময়িকপত্র’ (১৯৬৯), ‘মুনীর চৌধুরী’ (১৯৭৫), ‘স্বরূপের সন্ধানে’ (১৯৭৬), ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ (১৯৮৩), ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’ (১৯৮৩), ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ (১৯৮৪), ‘মোতাহার হোসেন চৌধুরী’ (১৯৮৮), ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭), ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’ (১৯৯৮), ‘আমার চোখে’ (১৯৯৯), ‘বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে’ (২০০০), ‘পূর্বগামী’ (২০০১), ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩) উল্লেখযোগ্য।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় তার রয়েছে আকরগ্রন্থ ‘আইন-শব্দকোষ’। তার এসব কাজ জাতিকে, ভাষাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে। সেজন্য দেশ-বিদেশে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা।
এর মধ্যে রয়েছে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬); স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮); দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩); একুশে পদক (১৯৮৫); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬); লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬); বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০); দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩) ও অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট (২০০৫)।