ঢাকা কলেজের সাবেক প্রিন্সিপালের ৮ সন্তানই হাফেজে কোরআন
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সর্বপ্রথম উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা কলেজ। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রায় পৌনে দুইশত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক সূর্য সন্তান। বিভিন্ন সময়ে এই কলেজের নেতৃত্ব দিয়েছে অনেক কিংবদন্তী। এমনই একজন হলেন কলেজটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল প্রফেসর মো: নূরুল হক মিয়া।
পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন ১৯৬৯ সালের দিকে। অধ্যাপনা করেছেন দেশসেরা প্রতিষ্ঠান সমূহে। সিলেট এমসি কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ, টাংগাইল করোটিয়া কলেজ, ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। প্রায় দীর্ঘ এক যুগ ছিলেন ঢাকা কলেজে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন চার বছর। সর্বশেষ ২০০১ সালে তিনি ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার অজপাড়ায় ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই জন্ম হয় এই মহান ব্যক্তির। নূরুল হক শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। সেশন ১৯৬৬-৬৭। থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম হলের ৩৫৯ নম্বর রুমে।
পড়াশুনার জীবনের সঙ্গিসাথিদের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিখ্যাত অনেকেই আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। আমার পাশেই ৩৬১ নম্বর রুমে থাকতো আব্দুর রাজ্জাক। তিনি পড়তেন পলিটিক্যাল সাইন্সে। তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। আমরা এক সঙ্গে চার বছর ছিলাম। তার সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল আমার। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাবেক শীর্ষনেতা ও মন্ত্রী ছিলেন।
প্রফেসর মো: নূরুল হক মিয়া বলেন, তোফায়েল আহমদ তখন ইকবাল হলের ভিপি। আরও ছিলেন, পিডিবির চেয়ারম্যান ফেরদাউস আহমদ কোরাইশি। সেও এক সময় মন্ত্রী ছিলেন। তারপর সিরাজুল আলম খানও আমার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। যাকে বলা হয় রাজনীতির রহস্য পুরুষ। রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীরাও ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু তখন তারা কমিউনিস্ট পার্টি করতো, তাই তাদের সঙ্গে মেশা হতো না। এছাড়াও রশিদ, কায়সার, মোতালেবসহ ভার্সিটি জীবনের অনেক বন্ধুদের কথা মনে পড়ে।
প্রফেসর নূরুল হক মিয়া বিখ্যাত ছিলেন রসায়নবিদ হিসেবে। কেমিস্ট্রি প্রফেসর হিসেবে তার খ্যাতির মূল কারণ ছিল বই। ইন্টার ও ডিগ্রি ক্লাসে রসায়নের ওপর লিখিত তার সাতটি বই সিলেবাস ভুক্ত। বিশেষ করে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সারা দেশে এককভাবে রাজত্ব করেছে ইন্টারের তার লেখা রসায়ন বইটি। দ্বিতীয় কোন বই ছিল না।
নীলক্ষেতের পুরনো দোকানদাররা এখনো নূরুল হক ঢাকা কলেজ বললে চিনে। কিন্তু প্রকাশকের ব্যর্থতায় বইগুলো এখন বাজারে নেই বললেই চলে। ভালো কোন প্রকাশক উদ্যোগ নিলে আবারও সেগুলো বাজারে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
নিভৃতচারী এই জ্ঞানতাপস সারা জীবন সহজ সরল জীবন যাপন করেছেন। যতদিন প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রিন্সিপালের সুবিধাগুলো নেননি। সরকারি গাড়ি, সরকারি বাংলো কোনো কিছুই নেননি। এমনকি মোবাইল ফোনও না। লালবাগের বাসা থেকে পায়ে হেটেই অধিকাংশ সময় কলেজে আসতেন। যখন প্রিন্সিপাল ছিলেন তখনো একই নিয়ম ছিল।
জীবনের প্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহপাক আমাকে দুনিয়াতে অনেক সম্মান দিয়েছেন, ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের চেয়ারে যেদিন প্রথম বসি, তখন সবাই বলেছিল, ঢাকা কলেজের দেড়শত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম দাড়ি টুপিওয়ালা কেউ প্রিন্সিপালের চেয়ারে বসলো। আমার সৌভাগ্য সেই সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার বই আমাকে যে সম্মান এনে দিয়েছিল তা ভুলার মতো না।
তিনি বলেন, তাবলিগের জামাতে আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতাম। মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখতাম, আশপাশের কলেজ থেকে ছেলে-মেয়েরা আমাকে দেখার জন্য ভিড় করছে। লাইন ধরতো সবাই আমার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। আমাকে ক্লাস করানোর জন্য অনুরোধ করতো, কলেজে নিয়ে যেত।
তার ছোট ছেলে এহসানুল হক বলেন, পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হওয়ায় আব্বার সোনালী সময় আমার তেমন দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বাবার ক্রেস্টগুলো যখন দেখি ভালো লাগে। ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের মাথার ওপর টাঙানো তালিকায় আমার বাবার নামটি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, কেমন আনন্দ লেগেছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো না। আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে দীর্ঘদিন পিজি হাসপাতালে ভর্তি ছিল। কোনভাবে ডাক্তাররা পরিচয় জানলেন, তখন দেখা গেল উপস্থিত সব ডাক্তারই বাবার ছাত্র। সবাই বাবার বই পড়েছেন। এমন অনেক সময়ই হয়।
এহসানুল হক বলেন, বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন, ভারমুক্ত হলেন না কেন? তিনি বলেছিলেন, দরকার কী? সে জন্য তদবির করতে হত। আমি তো সেগুলো করবো না। অথচ তিনি একটু চাইলেই পারতেন। তৎকালীন সময়ে আব্বার স্কুল সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহমত আলী গাজীপুরের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলের চার বছরের সঙ্গী আব্দুর রাজ্জাক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। আরও কত বন্ধুবান্ধব। একটু চাইলেই পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
আব্বা বলতেন, প্রিন্সিপাল হয়ে একটা সমস্যা ছিল। অনেক সময় মিটিং করতে হতো নামাজের সময়ে। বিরতি দেয়া যেত না। যেভাবে দীর্ঘদিন চলে আসছে, আমার পক্ষে সেটা পরিবর্তন করাও সম্ভব ছিল না। নামাজ পাগল বাবা কোনদিন ছাত্র পড়াতে পারেননি। কারণ আজান হলেই সবাইকে বসিয়ে রেখে আব্বা চলে যেতেন মসজিদে।
বাবার বন্ধু রহমান আলীর ছেলে ঢাকা কলেজের বিখ্যাত ছাত্র বর্তমান পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা মার্কিন বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এম. জাহিদ হাসান তাপস আমাদের বাসায় নিয়মিত পড়তে আসতেন। এই খবর কলেজে ছড়িয়ে পড়লে আরও অনেক ছাত্র এসে ভিড় করতো। কিন্তু এই সমস্যায় ছাত্র টিকতো না। আব্বা সবাইকে বসিয়ে রেখে মসজিদে চলে যেতেন। শুধু মসজিদে যেতেন তাই না, তাবলিগের আমল শেষ করে বাসায় ফিরতেন। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ার আগ পর্যন্ত কখনোই জামাত ত্যাগ করতেন না।
প্রফেসর মো: নূরুল হক মিয়া প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের জামাতা। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই তাবলিগ জামাতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অধ্যাপনা ও লেখালেখির পাশাপাশি সারা জীবনই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করেছেন। চাকরি জীবন থেকে অবসরের পর অনেক ধরনের অফার থাকলেও তিনি সেগুলো গ্রহণ করেননি। তাবলিগের কাজ করেছেন। বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন।
তিনি দুই ছেলে ও ছয় কন্যার জনক। সবাইকেই তিনি কোরআনে হাফেজ বানিয়েছেন। দুই ছেলেই মাওলানা। দুইজনই দেশে প্রথম সারির দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শিক্ষক। তিনি বলেন, কলেজ জীবনে আমার সহকর্মীরা বলতো, স্যার, সবাইকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, ওরা খাবে কী? আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করেছিলাম। একইসঙ্গে সন্তানদের কথা চিন্তা করে একটি ইসলামি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আল্লাহপাক সন্তানদের খারাপ রাখেননি।
তিনি আরও বলেন, আমি সন্তানদের জন্য পিএইচডি পর্যন্ত করিনি। আমেরিকায় পিএইচডি করার একটা সুযোগ আমার এসেছিল, কিন্তু আমি ভাবলাম আমেরিকায় পরিবার নিয়ে গেলেও সমস্যা; না নিলেও সমস্যা। নিলে সমস্যা হলো, সেখানকার পরিবেশে মনমানসিকতা বদলে যেতে পারে, আর না নিলেও সমস্যা হলো দেশে তারা বাবার নেগরানি থেকে বঞ্চিত হবে। শুধু এ জন্যই আমার পিএইচডি করা হয়নি। আমার সঙ্গের অনেকেই আমেরিকায় গিয়ে পিএইচডি করেছে।
বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে, প্রফেসর মো: নূরুল হক মিয়ার ছেলে বলেন, বাবার হাইপ্রেসার অনেক আগে থেকেই ছিল। ডাইবেটিস থাকলেও সেটা কম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, গত কয়েক বছর যাবত বাবার পারকিনসন। আস্তে আস্তে চলাচল শক্তি একেবারেই কমে আসছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া এখন চলতেই পারেন না। তবে মেধাটা এখনো পরিপূর্ণ সতেজ আছে।
আজিমপুরস্থ আমতলা রোড ৩০ নং শেখ সাহেব বাজারের বাসাতেই তিনি বসবাস করছেন। ঢাকা কলেজের কেমিস্ট্রি বিভাগ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তেমন করো সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। আগে আমার যে টিএনটি নম্বর ছিল সেটাও এখন বন্ধ। এ কারণে হয়তো কেউ পায় না। তাছাড়া বর্তমান ব্যস্ত জীবনে কেই বা কাকে মনে রাখে?
কর্মজীবনে কত ব্যস্ত ছিলেন। কতহাজার ছাত্র পড়িয়েছেন। তারা আজ বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। জীবনের শেষ বেলায় তিনি এখন অখণ্ড অবসরে। সারা দিন বিছানায়। সহায়তা ছাড়া চলতে পারেন না। বর্তমান সময় কিভাবে কাটছে জানতে চাইলে প্রফেসর মো: নূরুল হক মিয়ার ছেলে বলেন, এখন রমজান চলছে, যত কষ্টই হোক তবুও তিনি রোজা রাখবেন। আমরা না করলেও লাভ হয় না। তিনি রোজা রাখবেনই। শুধু রোজাই নয়, হুইল চেয়ারে বসে তারাবীহও পড়বেন। লকডাউনের উসিলায় আমরা দুইভাই, এক ভাগিনাসহ বাবা মাকে নিয়ে তারাবীহর জামাত করছি। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব আমাকে এই সুন্দর সুযোগটা করে দিয়েছে। বাবা-মার সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। বাবার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক।