১৪ নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ১৪ নারী মুক্তিযোদ্ধকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এ সময় উত্তরীয় পরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তাদের হাতে সম্মাননা ও ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।
সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন- অধ্যাপক মমতাজ বেগম, ফরিদা খানম সাকি, রমা দাস, হিরন্মময়ী দাস রুনু, কৃষ্ণা রহমান, মৃণালিনী ওঝা, পদ্মা রহমান, ডা. মাখদুমা নার্গিস, কল্যাণী ঘোষ, কনক প্রভা মন্ডল, বুলবুল মহলানবিশ, শাহীন সামাদ, শারমিন মুরশিদ, ডালিয়া নওশীন।
আজ মঙ্গলবার (৩১শে ডিসেম্বর) ‘গৌরব ৭১’ এবং ‘শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন’-এর যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলির সদস্য আব্দুর রহমান, সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা খানম, ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, ‘গৌরব ৭১’-এর সভাপতি এস এম মনিরুল ইসলাম মনির, উপদেষ্টা এডভোকেট সানজিদা খানম প্রমুখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্মাননাপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাগম ঘটে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী বুলবুল বলেন, এই মাস আমাদের সবচেয়ে গর্বের মাস, সবচেয়ে অহংকারের মাস। আমাদেরকে বলা হয় কন্ঠযোদ্ধা। আমি গোখরা ক্যাম্পে ট্রেইনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু যাদেরকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন তাদের বলেন, আমি তোমাদের বাবা।
বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতি বলেন, আজকাল জয় বাংলা স্লোগানকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই স্লোগানকে আমরা ২০১৪ সাল থেকে আমরা জাতীয় স্লোগান করার জন্য সভা সমাবেশ করে আসছি। এ সময় ‘জয় বাংলা’র পাশাপাশি ‘জয় বঙ্গবন্ধু’কে জাতীয় স্লোগান করার দাবি জানান তিনি।
নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমান বলেন, বিয়ের পর আমি মুসলমাম হয়েছি, জন্মসূত্রে হিন্দু। আমরা বোরকা পড়ে বিভিন্ন গোপন খবর রাখতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাজি রেখে সাহায্য করতাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েও মানুষের কাছে পরাধীন। নতুন প্রজন্ম যেন ভুলে না যায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
কল্যাণী ঘোষ বলেন, ১৯৭১ সালে আয়ার বয়স ২৫ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা শুরু করি। ঐ সময় স্বাধীনতার ডাক আসলে বেরিয়ে পড়েছি। কখনো গোয়াল ঘরে, কখনো জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম। অনেক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটায় সেখানে আর থাকতে পারিনি। ২১শে এপ্রিল পরিবারের ২৩ জনকে নিয়ে মাতৃস্থান ত্যাগ করলাম। সবাই কাঁদা মেখে ছিলাম। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চাঁদরে মোড়ে বাবাকে নিয়ে যাই। দেশমাতৃকার জন্য আমার একমাত্র দেওয়ার ছিল আমার কণ্ঠ। তাই করেছি আমি।
কৃষ্ণা রহমান বলেন, আমি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি ছিলাম। আমি কখনো আওয়ামী লীগ ছিলামনা। তারপরেও আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। শেখ হাসিনাও আমাকে আওয়ামী লীগ করতে বলেননা। মুক্তিযোদ্ধাদের ভুললে চলবেনা।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, কোথাও বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, কোথাও রাজাকাররা ধরছে। অনেক কষ্ট সাধনার মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। আবার যদি কোন শেয়াল-শকুন আমার দেশকে টানাটানি করে, আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছি, কিন্তু ট্রেইনিং নয়। যতদিন দেহে রবে প্রাণ, ততদিন হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান।
মাখতুমা নার্গিস বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য এক মহাসমুদ্রের মত ছিল। সেই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলায় বিচরণ করছি আমরা।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাহী সদস্য এডভোকেট সাজেদা খানম বলেন, আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি। তবে টিউবওয়েল চাপিয়ে পানি খাইয়েছিলাম। এটাই আমার গর্ব।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন বলে আজকে আমরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছি। আমরা পুরুষ রাজাকার দেখলেও কিন্তু নারী রাজাকার দেখতে পাইনা। নারীরা তাদের স্বামীকে, ছেলেকে, ভাইকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দেশে এই চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর এক অন্যতম দেশ হিসেবে উপস্থাপিত হবে। পাকিস্তানের মানুষ এখন স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের মত একটা দেশ গড়ার।
এছাড়াও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে আহবান জানান তিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করতে চায় তাদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেচহিলেন তারা অনেক ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে শহীদ হয়েছেন,অনেকে বেঁচে আছেন। তাদের সবাই নিশ্চয় শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো হবে তখনি যখন যে উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধ করেছিল সে উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে পারব।
সাদ বিন কাদের বলেন, একটা মানুষ তার জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনা। কিছু কিছু স্বপ্ন কোন সংগঠন, মানুষ পূরণ করে। আমিও মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু আমার স্বাধীন বাংলাকে দেখেছি, এটি আপনারাই উপহার দিয়েছেন।
ঢাবির প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ভারতবর্ষ এর ইতিহাস মাতৃময়। মায়েরা মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন দিয়েছেন,অবদান রেখেছেন । জাতীয় পতাকার মাঝখানের লাল অংশের লালটা বিন্দু বিন্দু রক্তবিন্দু দিয়ে গঠিত। বঙ্গবন্ধু আমাদের এই দেশ দিয়ে গেছেন, তিনি আর নেই।কিন্তু আমাদের সামনে আছেন তার সুযোগ্য কন্যক শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা।
বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ সভাপতি মন্ডলির সদস্য আব্দুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অবদান না রাখলে দেশ স্বাধীন হতনা বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, যে যার জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য করেছিলেন। তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
এর আগে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। এরপর বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় ‘গৌরব ৭১’। তিনটি পর্বে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মকথা। দ্বিতীয় পর্বে উত্তরীয় পরিধান ও ক্রেস্ট প্রদান এবং তৃতীয় পর্বে ছিল অতিথিদের বক্তব্য।