৫ ছাত্রী নিয়ে স্কুল চালু করেছিলেন বেগম রোকেয়া

আজ ১০ ডিসেম্বর, এক মহীয়সী নারীর প্রয়াণ দিবস। এদেশের নারীদের প্রথম শিক্ষার আলো দেখিয়েছিলেন যিনি, বাঙালি মুসলিম নারীদের শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়েছিলেন যিনি, সেই মহীয়সী নারী হলেন বেগম রোকেয়া। তিনিই প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে তিনিই কলম ধরেন। কলম ধরেন নারীকে পণ্যকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাতে। যার লেখনীতে ঘোষিত হয়েছিল মানুষ হিসেবে ভগিনীদের আত্মসম্মান ও নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা।

বাংলার পশ্চাৎপদ মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তার পিতার নাম ছিল মুহম্মদ নূর সাহেব আবুল কামু সাবের জহিরুদ্দীন মুহমদ আবু আলী হায়দার সাবের। তার মাতার নাম রাহাতন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী। পিতা ও মাতার দিক থেকে বেগম রোকেয়া উচ্চবংশীয় এবং জমিদার শ্রেণীভুক্ত। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়ে হয়। ১৮৯৮ সালে তিনি খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মের অল্প কয়েক মাসের মধ্যে মারা যায়। ১৯০৯ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করলে বেগম রোকেয়া বৈধব্য জীবন বেছে নেন এবং সমাজসেবামূলক কাজ ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তার কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি কলকাতার বেথুন ও গোখেল মেমোরিয়াল প্রভৃতি স্কুলে গিয়ে প্রথমে স্কুল পরিচালনা সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ১৯৩০ সালে বেগম রোকেয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমে একটি উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তার এই কাজের প্রশংসা করেন ব্রিটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী সরোজিনি নাইডু। তিনি তাকে একটি চিঠিতে লেখেন, “কয়েক বছর থেকে দেখছি যে আপনি কি দুঃসাহসের কাজ করে চলেছেন। মুসলিম বালিকারদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন এবং তার সাফল্যের জন্য দীর্ঘকালব্যাপী যে কাজ হাতে নিয়েছেন, তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর।”

১৯৩১ সালে রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রথমবারের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং স্কুলের প্রায় ৬০০ ছাত্রী বঙ্গীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সাথে পাশ করে। সেই থেকে এখনো এই স্কুল অত্যন্ত সফলভাবে নারী শিক্ষায় নিজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছে। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ১৯৩৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে সরকার এই স্কুলের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কঠোর সাধনা আর অধ্যবস্যায়ের মধ্য দিয়ে এই স্কুলের ভিত রচনা করেছিলেন রোকেয়া নিজে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ছাত্রীদের মেনে চলতে হতো সুনির্দিষ্ট নিয়মাদি ও রুটিন। স্কুলের কল্যাণের জন্য নিজের ছোট বোন হোমাইরাকে ছাত্রীদের হোস্টেল পরিচালিকা নিযুক্ত করেন। ছাত্রীদের জন্য তৈরি তার শিক্ষাপদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও প্রশংসার দাবিদার।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা, হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজ, এমনকি শরীরচর্চার শিক্ষা ছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো। ভাবা যায়? যে সময়ে মেয়েদের বাড়ির বারান্দায় আসার আগে দুবার ভাবতে হতো, তখন রোকেয়া ভেবেছিলেন মেয়েদের শরীরচর্চা শিক্ষার কথা! কত সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল ছিলেন তিনি! ১৯৩০ সালের পর থেকেই রোকেয়ার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে, বাসা বাঁধে নানা রোগ। ডাক্তারের পরামর্শে তার অনেকগুলো দাঁত তুলে ফেলতে হয়, পেটের সমস্যার সাথে সাথে দেখা দেয় কিডনির সমস্যা। এ সময় মাঝে মাঝে হাওয়া পরিবর্তন ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যেতেন ঘাটশিলায়।

কিন্তু কাজের টানে আর মনের বলে বারবার ফিরে আসতেন কলকাতায়। ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর রোকেয়া রোজকারমতো রাত ১১টা পর্যন্ত লেখালেখি করে ঘুমাতে যান। ৯ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে ওজু করেই কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তার আসার আগেই ভোর ৫:৩০ মিনিটে ঢলে পড়েন তিনি। দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে কলকাতা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চব্বিশ পরগণার সোদপুরের শুকচার এলাকায় আত্মীয় আব্দুর রহমান খানের পারিবারিক কবরস্থানে বেগম রোকেয়া চিরনিদ্রায় শায়িত হন।


সর্বশেষ সংবাদ