সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্য শূন্য চেয়ার রেখে শ্রদ্ধা, স্মরণে কাঁদলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা
কিছু মানুষ আছেন, যারা চলে গেলেও অমর থেকে যান তাঁদের কর্ম, চিন্তা ও কীর্তির মধ্য দিয়ে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন সেই ধরনের একজন। তিনি ছিলেন শুধুই শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ শিক্ষক নয়; তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত এবং বিচিত্র। সাহিত্য, শিক্ষা, গবেষণাসহ বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে তার অবদান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
আজ বুধবার প্রয়াত অধ্যাপক ও সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মরণসভায় শিক্ষার্থীরা এবং সহকর্মীরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। বক্তারা তাঁর অবদানের কথা বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, চোখের জল ফেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে ইংরেজি বিভাগ আয়োজিত স্মরণসভার মঞ্চে রাখা একমাত্র চেয়ারটি ছিল শূন্য। যেন এক চিরন্তন শ্রদ্ধার প্রতীক। সেই শূন্য চেয়ার যেন জানান দিচ্ছিল, কেউ নেই, কিন্তু স্মরণ এবং প্রভাব চিরকাল অম্লান।
স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে কখনো বিষণ্ন দেখিনি। একের পর এক কাজ করতে দেখেছি। শুধু হাঁটতেন আর এক কাজ থেকে অন্য কাজ করে যেতেন।’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সহপাঠী, বন্ধু ও সহকর্মী অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘তিনি ছিলেন নক্ষত্রের মতো। অনেক শিক্ষার্থীর জীবনকে তিনি আলোকিত করেছেন। তাঁর চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারিনি। তিনি যাঁদের কাঁদিয়ে গেলেন, আমি তাঁদের একজন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ‘সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক মানুষ। ছিলেন সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক এবং নন্দনতত্ত্বে অগাধ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন একজন মনীষী। আমরা তাঁকে কখনো শ্রেণিকক্ষের চারদেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ একজন শিক্ষক হিসেবে দেখিনি। তাঁর কাজের পরিধি ছিল বিচিত্র ও ব্যাপক।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘কিছু মানুষ মৃত্যুর পরও অমর থেকে যান তাঁদের কর্ম ও কীর্তির মধ্য দিয়ে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই অমরদেরই একজন। তাঁর সাহিত্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সমালোচনা ও নন্দনতাত্ত্বিক অবদান আমাদের প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে কবি সাজ্জাদ শরিফ তাঁর অনেক স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাধুর্যে ভরা একজন মানুষ। আমরা রাতের পর রাত জেগে ওনার বাসায় আড্ডা দিয়েছি। তাঁর ছাত্র, সহকর্মী ও তাঁর সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের জীবনে তিনি যে ছোঁয়া দিয়ে গেছেন, তিনি না থাকলেও তা সারা জীবন থেকে যাবে। এটাই একজন সত্যিকারের মানুষের, একজন সত্যিকারের শিক্ষকের সবচেয়ে বড় সম্মান ও স্বার্থকতা।’
ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব স্মরণসভায় তাঁর প্রয়াত শিক্ষকের আত্মার শান্তি কামনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন। স্মরণসভায় ইংরেজি বিভাগের অন্য শিক্ষকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গত শুক্রবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরে তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ওপর পিএইচডি করেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বহুদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যোগ দেন।
প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস—সব ক্ষেত্রে ছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিচরণ। বলা হয়ে থাকে, তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন, যাতে বাস্তব ও অবাস্তবের তফাত ঘুচে জাদুবাস্তবতার স্পর্শে সামান্য ঘটনাও অসামান্য হয়ে ওঠে। তাঁর ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ ১৪১১ বঙ্গাব্দে (২০০৫ সাল) প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল বইয়ের পুরস্কার পায়। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে একুশে পদক পান।