নুসরাত জাগরণে যোগ দেওয়া সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা সেই ম্যাজিস্ট্রেটের
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার পর জেলার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে আলোচনায় এসেছেন সেখানকার সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। বিশেষে করে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির করুণ পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এবার নুসরাতের হত্যার পর যারা সরব হয়েছেন তাদেরকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি। ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে ন্যায়ের মিছিলে অংশ নেওয়া সবার প্রশংসাও করেছেন তিনি। তার স্ট্যাটাসটি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো-
‘ন্যায়ের মিছিলে ফেনীবাসীর ভালোবাসার নৈবেদ্য, বিনম্র শ্রদ্ধা!
আমিও ভালোবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছিলাম সুনীলদা, কিন্তু আমার প্রাণ মুক্তির আহ্লাদে মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। সেই বেরিয়ে যেতে চাওয়া প্রাণকে ওরা আটকে দিল। আমাকে নাকি বেঁচে থাকায় রঙ মাখাতে হবে, আমাকে নাকি লাইফ সাপোর্ট নিয়ে ধুকতে থাকা সভ্যতার নাকে ভালোবাসার মাস্ক পরিয়ে দিতে হবে। ওরা আমার চোখে মায়া লাগাইল, দিওয়ানাও বানাইল ;করিম বয়াতী!
আমি খুব সভ্য একটি নাক-উঁচু, নিরাপদ আর ছুটিসর্বস্ব জীবনই চেয়েছিলাম। আমি আরো কিছু আমাদের ভিড়ে বসে একটি নির্লজ্জ মোসাহেবি যাপন শান্ত ঢেউতোলা নদীর চেনা তীরেই ভিড়াতে চেয়েছিলাম। আমি বাঁশের কেল্লায় তিতুমীরের মূঢ়তাকেই দেখেছি, হাতবোমায় ক্ষুদিরামের শিশুতোষ অজ্ঞতাকেই দেখেছি!! আমি খুব সাধারণের এক সাদামাটা বিজ্ঞাপন বিজ্ঞানের আলোয় নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু ওরা আমায় মায়া লাগাইল বয়াতী, ওদের ভালোবাসা আমায় খুব বাজেভাবে ছুঁয়ে গেল।
ওরা যখন তরকারির বাজারে টমেটোর দাম বেড়ে যাওয়ার নৈমিত্তিক কৈফিয়ত ক্রেতার সামনে আমতা আমতা করে নিয়ে আসছিল; তখন হয়তোবা আমি হকিন্সের গ্রান্ড ডিজাইনে সূর্যের জীবন-মরণ ও আমাদের গ্রহের ভবিষ্যৎ পড়ছিলাম। ওরা যখন সিএনজির চাকায় সংসার নিয়ে ঘুরছিল, তখন আমি হয়তোবা উত্তরার মেইনল্যান্ড চায়না রেস্তোরায় চারপাশ ভুলে কোন এক উঠতি তরুণীর চোখের কালোয় ডুবে যাচ্ছিলাম।
আমাকে যে চায়ের দোকানি অনেকখানি দৌড়ে খুঁজে আনল, আমার জন্য এক কাপ চা যত্ন আর ভালোবাসা মিলিয়ে বানিয়ে বিস্ময় নিয়ে আমার চা খাওয়া দেখল, সেই চোখে এক অদ্ভুত বোবা ভালোবাসা ছিল। দোকানিকে আর বলা হলো না- তোমাকে ও তোমাদেরকে ভেবে আমার চোখ ভিজেছিল, আমাকে তুমি দিওয়ানা বানিয়ে ফেলছ।
ওরা কেউ দোকানি, কেউ চালক, কেউ স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী, কেউ ক্লান্ত শিক্ষক, কেউ ডুবন্ত রাজনীতিবিদ, কেউ হলুদ-সরষে তরুণী, কেউ অর্ধ-কম্প্রোমাইজড, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মী, কেউ উঠতি ছাত্রনেতা, কেউ জীবন সংগ্রামকে প্রতিদিনের হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় শুদ্ধতার মিছিলে যোগ দেওয়া সাংবাদিক, কারো কারো চালচুলোয় ঝামেলা আছে, কেউ কেউ গ্রাম থেকে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শহরে আসা ভবঘুরে, কেউ কেউ নির্যাতিত।
ওরা এক খুব ছোট শহরের ছোট ছোট সাধারণ মানুষ। সমাজের দাঁড়িপাল্লায় ওদের ওজন অনেক কম, সমাজপতিদের কাছে ওরা খুব সাধারণ, সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে ওরা ** ম্যাটার করে না**। রাষ্ট্র ওদের মালিকানা বুঝিয়ে দেয় না, ওরা দলিলহীন সম্পত্তির বায়বীয় মালিকানা নিয়ে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে বেঁচে থাকে। ওদের পতাকা সবসময় লাল, ওদের চোখ সবুজ।
আমার দিকে চেয়ে যে **কিছুই বোঝে না** তরুণ স্বপ্ন দেখে ফেলল; তাকে বলা হয়নি আমি কত ছোটলোক, কত অসহায়, কত বেশি দুর্বল, কি পরিমাণ বেয়াদপ আর কি ভীষণ রকম শক্তিশালী (ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর কি)!! আমায় তোমরা এত মায়া করলে, এতটা না বুঝেই ভালোবাসলে, এত বেশিই বাসলে যে আমার হকিন্স-চে-ফ্রয়েড সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা ছোঁয়াচে জানতাম; এত বেশি ছোঁয়াচে আগে বুঝি নি।
ওরা খুব ঝোঁকপ্রবণ, ভীতু আর অসহায়। কিন্তু ওরাও একটি ন্যায়পরায়ণ নিরাপদ পৃথিবী দেখার সাহস করে ফেলে, সুস্থ সভ্যতার দলিলে না বুঝেই স্বাক্ষর করে ফেলতে পারে। ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ওদের ধারালো। ওদের অনেকেরই পৃথিবী ফেনী, ওরা প্রায় সবাই রাষ্ট্রকে নিচ থেকে দেখে, ওদেরকে ভয় দেখিয়ে দমনও করা যায়!
কিন্তু ওদের ভালোবাসা সস্তা না, ভালোবাসা কোনকালেই সস্তা ছিল না। ওদের স্বপ্নও ভীষণ রকম সবুজ, ওদের এই ভালোবাসার শক্তি দিয়ে কয়েকটি সবুজ পৃথিবী গড়ার আকাশ-কুসুম গ্র্যান্ড ডিজাইন ছোট এক কালো ডায়েরীতে লিখে ফেলায় যায়।
ওদের এইসব নীলপদ্ম নিয়ে একটা মূঢ় জীবন তীতুমীরের বাঁশের কেল্লায় কাটানোই যায়, অযাচিত আর অপ্রয়োজনীয় কিছু সাহস দেখানোই যায়।
ওদের জন্য বড়দের কাছে অনেক ছোট হওয়াই যায়, ওদের ভালোবাসার লাল কাপড় নিয়ে দুরন্ত ষাঁড়ের কাছে ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই চলে যাওয়া যায়!!
ভালোবাসাকেই সমাধান বলেছিলেন আইনস্টাইন, আপনি কি বলেন, সুনীলদা!!
নুসরাত জাগরণে ন্যায়ের মিছিলে যোগ দেওয়া সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা...’
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে দুর্বৃত্তরা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এঘটনায় গুরুতর আহত নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার রাতে মারা যান। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তার জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে এবং আট জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে নুসরাতে ভাই নোমান মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এজাহারভূক্ত সাত জনসহএ পর্যন্ত ১৩জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।