অন্যের কাছে সুন্দর হতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি
সবার কাছে নিজেকে সুন্দর করে তুলতে গিয়ে, অন্যদের কাছে আকর্ষণীয় বা প্রিয় হয়ে উঠতে গিয়ে একসময় যে বাংলাদেশের অনেক নারী নিজের সত্ত্বাকেই হারিয়ে ফেলছে, সেসব গল্প ছবির মাধ্যমে তুলে এনেছেন একজন আলোকচিত্রী। আলাপকালে আলোকচিত্রী হাবিবা নওরোজ জানাচ্ছিলেন, ‘খুব তিক্ত ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার’ পর তিনি এই কাজটি শুরু করেছিলেন। ‘এতদিন তো অন্য মানুষদের খুশি করার জন্য কাজ করছিলাম, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম- এই কাজটি আমি করতে চাই নিজেকে খুশি করার জন্য।’
নিজের কাছেই অপরিচিত হয়ে ওঠা
প্রায় ছয় বছর ধরে ছবি তুললেও, ২০১৪ সালের দিকে ‘কনসিলড’ নামের একটি ছবির সিরিজ শুরু করলেন হাবিবা নওরোজ। যেখানে তিনি তুলে এনেছেন নারীদের আপোষ, সংগ্রাম, অন্যদের খুশি করতে গিয়ে নিজের হারিয়ে যাওয়ার মতো নানা বিষয়। ছবিগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজের ওয়েবপেইজে তিনি লিখেছেন, ‘নিজেকে সুন্দর, আকর্ষণীয় বা প্রিয় করতে তুলতে গিয়ে নারীরা তাদের নিজস্ব সুন্দর সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলে, তাদের ব্যক্তিত্ব, গল্প বা কষ্টের বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়।’ ‘এ সময়ে তারা হয়ে ওঠেন কৃত্রিম একজন, যে নিজের কাছেই অপরিচিত হয়ে ওঠে।’ এসব ছবিতে নানা পোশাক পরা নারীদের ছবি তোলা হয়েছে, যাদের মুখ নানা ধরণের আবরণে ঢাকা।
প্রদর্শনী
কেন এই থিম বেছে নিলেন?
আলোকচিত্রী হাবিবা নওরোজ বলছেন, ‘আইডিয়াটা আসে যখন মনে হলো যে একজন নারী হিসাবে যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, সেটা আমার কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা দরকার।’ তিনি জানান, ‘আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়েছি, তখন দেখতে পেলাম আমার সোসাইটি [সমাজ], আমার চারপাশের মানুষজনের নানা প্রত্যাশা আমার কাছে।’ ‘আমার একটি বিয়ে করতে হবে, বাচ্চা নিতে হবে, ভালো বেতনের চাকরি যোগাড় করতে হবে ইত্যাদি।’ নওরোজ বলেছেন, ‘এতসব প্রত্যাশার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, একজন ব্যক্তি হিসাবে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।’
‘আমার চারপাশের অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রেই দেখেছি, এই প্রত্যাশার চাপে চাপে তারা আসলে একসময় ভুলে যায় যে, তারা আসলে কী চেয়েছিল নিজেদের কাছ থেকে। তাদের সত্ত্বাটি তারা হারিয়ে ফেলেন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর একবছর ধরে ফটোগ্রাফি করার পরেও হাবিবা নওরোজের মনে হলো, ‘আমি যাই করছি, তাতে ঠিক খুশি হতে পারছি না।’ ‘তখন আমার আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা, অন্য ব্যক্তিদের নাকচ করা, তাদের প্রত্যাশা ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করার জন্যই এই কাজটি শুরু করলাম।’
এসব ছবিতে তিনি নিজে উপস্থিত না থাকলেও এসব ছবির মাধ্যমে আসলে তিনি নিজের নানা অভিজ্ঞতার বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছেন, বলছেন এই ফটোগ্রাফার। সেই ব্যক্তি পরিচয় মুছে যাওয়া, নারীর নিজেকে হারিয়ে ফেলার গল্পই তিনি বলতে চেয়েছেন 'কনসিলড' নামের এসব আলোকচিত্রে।
সেখানে দেখা যায়, নারীরা নানা ধরণের পোশাক পরেছেন, সেজে আছেন, কিন্তু তার মুখমণ্ডল দেখা যায় না। অর্থাৎ তাদের কোন পরিচিতি নেই। ‘আমার কাজকে মূল্যায়ন করা হচ্ছিল না...কেউ কাজগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না। তখন আমি অনেকটা মরিয়া হয়ে কাজ শুরু করি। নিজেকে খুশি করার জন্য, নিজের প্রতি সৎ থাকার জন্য,’ বলছেন তিনি।
হাবিবা নওরোজের প্রদর্শনী
আলোকচিত্রের প্রদর্শনী করতে গিয়ে হাবিবা নওরোজ দেখতে পেয়েছেন, তারা এসব ছবির বার্তা একজন নারী সহজেই বুঝে ফেলে। কিন্তু একজন পুরুষকে এসব ছবির বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলতে হয়েছে। এমনকি পুরুষ কিউরেটরকে কাছ থেকেও একই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছেন।
তিনি বলছেন, একজন নারী হিসাবে আলোকচিত্রের পথে হাঁটার পুরো সময়টা ছিল তার জন্য সংগ্রামের, যেহেতু এখনো বাংলাদেশে এই শিল্পে বেশি নারীর পদচারণ নেই। শুধু সম্প্রতি তিনি পরিবার বা পরিচিতজনদের মনোভাবের পরিবর্তন দেখতে শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন: রক্ত ঝরিয়ে দেয়ালে লিখলো ‘ভিসির পদত্যাগ চাই’
২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে এই সিরিজ এখনো চলছে। ক্যাননের ফাইভ ডি মার্ক থ্রি ক্যামেরা ব্যবহার করে তিনি ছবি তোলেন। বেসরকারি একটি সংস্থার গবেষণা কাজের পাশাপাশি ছবি তোলেন হাবিবা নওরোজ। দেশে বিদেশে মিলিয়ে তার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে। [বিবিসি বাংলা]