০৮ মার্চ ২০১৯, ১২:১২

ভারতীয়র সাথে প্রেমে জড়িয়ে ব্রিটিশ তরুণীর বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প

বিপিএল এবং ফ্রিদা বেদি  © বিবিসি

ফ্রিদা বেদি গতানুগতিক জীবন-যাপন করতেন না। ইংল্যান্ডের ছোট্ট একটি শহরে তার জন্ম। ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়ে ভারতে আগমণ ঘটলেও শেষ হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে। ফ্রিদার জীবনীকার অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড তার জীবনের অসাধারণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।

‘অনেক কিছু আছে যা লেবেল, রং এবং পক্ষপাতিত্বের চেয়েও গভীর। ভালোবাসা বা প্রেম তার মধ্যে অন্যতম।’ এটা একজন ইংরেজ নারীর কথা যিনি পূর্ব সংস্কারকে পেছনে ফেলে এক ভারতীয় শিখকে বিয়ে করেছিলেন এবং নারী ও স্ত্রীর বিষয়ে ভারতীয় ধারণা চ্যাঞ্জে করেছিলেন।

ফ্রিদা এবং তার বন্ধু বাবা পিয়ারে লাল বেদি (বিপিএল নামে বন্ধুমহলে পরিচিত) ছাত্রজীবনে অক্সফোর্ডে পড়ার সময় পরিচিত হন। ১৯৩০ সালের দিকে ভিনদেশী সংস্কৃতির কারোর সাথে সেখানে প্রেমের কথা চিন্তাও করা যেতো না, বিশেষ করে ফ্রিদা যে পরিবেশ থেকে এসেছেন এবং শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গেছেন। তিনি ইংল্যান্ডের পূর্ব মধ্যাঞ্চলের ডার্বি শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার বাবা গহনা ও ঘড়ি মেরামতের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন।

তার বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেশিনগান বাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশ নেন। সে সময় এই বাহিনীতে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটার কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘আত্মঘাতী ক্লাব বা স্যুইসাইড ক্লাব’। যুদ্ধাবস্থায় ফ্রিদার বয়স যখন সাত বছর, উত্তর ফ্রান্সে মারা যান তিনি। বাবার রাজনৈতিক আনুগত্য ও আধ্যাত্মবাদ পরে তার জীবনকে বদলিয়ে দেয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফ্রিদার জন্য পৃথিবীর দ্বার খুলে দেয়। তিনি হতাশায় আচ্ছন্ন একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি ছিলেন, যে সময়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা বিশ্বজুড়ে সংকট, বেকারত্ব ও ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।

শুরু থেকেই এমন কিছু মেয়ের সাথে ফ্রিদা বন্ধুত্ব করেন, যারা স্বভাবগতভাবে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি লেবার ক্লাব ও কমিউনিস্ট অক্টোবর ক্লাবের সভায় যোগ দিতেন।
ফ্রিদা ছিলেন অনুসন্ধিৎসু। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করতেন, তাদের জন্য তার সহানুভূতি ছিলো। এছাড়া তিনি একা অক্সফোর্ড মজলিসের সাপ্তাহিক সভায় যেতেন। সেখানে স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় ছাত্র তাদের দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনা করতেন। সুদর্শন ও আমুদে পাঞ্জাবী যুবক বিপিএল বেদিও সেখানে নিয়মিত যেতেন। শিগগিরই তারা ঘনিষ্ঠ হন এবং ফ্রিদা ও বিপিএল বিয়ে করেন।

১৯৩০ সালের দিকে অক্সফোর্ডের নারী কলেজ যৌনভাবনার দিক দিয়ে অগ্রসর ছিলনা এবং তা প্রতিরোধ করা হতো। কোন ছাত্রীর কক্ষে ছাত্র চা পান করতে গেলে তার সাথে কেউ অবশ্যই উপস্থিত থাকতো, দরোজা খোলা রাখা হতো এবং বিছানাটি সরিয়ে রাখা হতো। ফ্রিদার কলেজেও এটি ব্যাপকভাবে মানা হতো। কিন্তু ফ্রিদা কাউকে ছাড়াই বিপিএল’র সাথে দেখা করতেন। তিনি সাক্ষাতের নিয়মটিকে বর্ণবৈষম্য বলে মনে করতেন।

বন্ধুদের কারণেও ফ্রিদা ছিলেন ভাগ্যবতী। বারবারা ক্যাসল নামে তার এক বন্ধু পরবর্তীতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নারী নেত্রী হয়েছিলেন, তাকে ফ্রিদা তাদের বিষয়ে জানিয়েছিলেন। সেসময় বিস্ময়ের সাথে বারবারা বলেছিলেন, ‘তুমি নিশ্চয় তার গৃহবধূ হবে না।’ ফ্রিদার পরিবারও এ সম্পর্ককে মেনে নেয়নি। বিপিএল তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে মন জয় না করা পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিলো।

তাদের সম্পর্কের কারণে অক্সফোর্ডের অনেকের মধ্যে চৈতন্য তৈরি করেছিলো। অক্সফোর্ডের কোন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট যে ভারতীয় কোন ছাত্রকে বিষেয় করেছেন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। এমনকি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে, বিয়ে রেজিস্ট্রার তাদের সাথে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

বিয়ের পর ফ্রিদা নিজেকে ভারতীয় ভাবতেন এবং তেমন পোশাক পরা শুরু করেন। বিয়ের বছরখানেক পর চার মাসের সন্তান রাঙ্গাকে নিয়ে ইতালির ত্রিয়েস্তা থেকে ভারতের বোম্বে (এখনকার মুম্বাই) চলে আসেন।

ছাত্রাবস্থায় তাদের কর্মকান্ডের কারণে ভারতে রওয়ানা হওয়ার আগেই তাদেরকে বিপ্লবী এবং ঝামেলা সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো বৃটিশ সরকার। বোম্বের জাহাজে ওঠার আগে সাত ঘণ্টা তাদের ব্যাগ-ব্যাগেজ পরীক্ষা করা হয় এ সন্দেহে- তারা হয়তো বামপন্থী প্রচারণায় যুক্ত। ফ্রিদা জানিয়েছিলেন, রাঙ্গার ন্যাপকিনে কোনো বার্তা লুকানো আছে কিনা, তা পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখে তারা।

ফ্রিদার বিয়ের আরও ঝামেলা বাকি ছিলো। তার শ্বাশুড়ীর সাথে মিলিত হওয়া, বাবুজির সাথে প্রথম দেখা হওয়া তারমধ্যে ছিলো অন্যতম। বোম্বে থেকে কয়েকদিন সফর করে তাদেরকে পাঞ্জাবের ছোট শহর কাপুরথালায় পৌছাতে হয়। মধ্যরাতে তারা বাড়ি পৌছান। বিপিএল যখন তার মায়ের পা ছুয়ে প্রথাগত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন ফ্রিদাও তাকে অনুসরণ করেন। তখন তিনি তাদেরকে নিজের কাছে অশ্রুসজল চোলে টেনে নেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারত বৃটেনের পক্ষ নেওয়ায় ফ্রিদা এবং বিপিএল ক্ষুব্ধ হন। তখন বিপিএল আটক হন এবং তাকে মরুভূমির মধ্যে এক বন্দিশালায় রাখা হয়। সেসময় ফ্রিদাও সিদ্ধান্ত নেন জন্মভূমি বৃটেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।

তিনি মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সামিল হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাঠে নামেন। তিনি তার স্বামীর গ্রামে ডেরা বাবা নানকে যান এবং ভারত গণতান্ত্রিক না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সমর্থন না করতে আহবান জানান। সাদা নারীর এ আহবানে কিভাবে সাড়া দেবেন প্রশাসন বুঝতে পারছিলো না। তারা একজন ইংরেজ পুলিশ পরিদর্শককে ওই গ্রামে পাঠান এবং তাকে আটক করেন।

আটকের দিন সকালেই ফ্রিদাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। মাত্র ১৫ মিনিট বিচারকার্য চালানো তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটও অক্সফোর্ডের ছিলেন বলে ধারণা।

তিনি ক্ষুব্ধভাবে ফ্রিদাকে জানান, তার এ কর্মকান্ড অপ্রীতিকর। তখন ফ্রিদা এটাকে প্রীতিকর বলে উল্লেখ করেন। এরপর বৃটিশ নারী হিসেবে কোনো সুবিধা পেতে চান কিনা জানতে চাইলে ফ্রিদা বলেন, তাকে ভারতীয় হিসেবে বিবেচনা করলেই চলবে।

তাকে তখন ছয় মাস কারাদন্ড দেওয়া হয় এবং কারাগারে তাকে কঠোর পরিশ্রমের কাজ দেয়া হয়। সেখানে আসামীর তুলনায় রাজনৈতিক বন্দিই বেশি ছিলো।

দেশভাগের পর তারা কাশ্মীর চলে যান এবং ফ্রিদা বামপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের দিকে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরে জাতিসংঘের কাজে বার্মায় গিয়ে বৌদ্ধদের বিষয়ে জানার সুযোগ পান। সেখানে বৌদ্ধধম ধর্মান্তরিত হন।

১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বৌদ্ধরা যখন হিমালয় পর্বতমালা এলাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। এরপর বুদ্ধের বাণী প্রচারকে ব্রত হিসেবে নিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেন ফ্রিদা।১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ ভারতে মারা যান তিনি। সারাজীবন কখনো জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গের দ্বারা চলতে বাধ্য হননি ফ্রিদা। ফেরেননি কখনো নিজ মাতৃভ’মি বৃটেনেও। 

বিবিসি অবলম্বনে।