১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৪১

সেলিম আল দীনকে কেন ঢাবি ছাড়তে হয়েছিল?

সেলিম আল দীন

সেলিম আল দীন। নিরন্তর সৃষ্টিশীলতায় মুখর সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) বাংলা নাটকের নব্যধারার প্রবর্তক, নাট্যমঞ্চের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র! আজ তার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের এই প্রতিষ্ঠাতা। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাট্যকার সেলিম আল দীনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট, ফেনী জেলার সোনাগাজীতে। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গায়। লেখক হবেন এমন স্বপ্ন তিনি ছেলেবেলা থেকেই দেখেছেন। অবশেষে লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ ছাপা হয় ওই পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি নাটকে জড়িয়ে পড়েন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে।

সেলিম আল দীনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে। ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন সেলিম। ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু স্নাতক শেষ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে।

যতদূর জানা যায়, বাবার চাকরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করতে হয়েছে তাকে। সে সূত্রে তাকে টাঙ্গাইলে যেতে হতে পারে। তাই বলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছেড়ে নাম-ডাকহীন কলেজে। ব্যাপারটি স্পষ্ট নয়। তাকে নিয়ে লেখা কোনো লেখকের অনেক গ্রন্থ বা প্রবন্ধেই এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যদিও সাদত কলেজ থেকে সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন সেলিম।

সেলিম আল দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স না করলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার সখ্যাত অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি। লেখক শামীমা দোলা ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফ। ক্লাস শুরু হলো। একেবারে পিনপতন নীরবতা। শুরুতে কয়েকজনকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তিনি, বেশির ভাগই তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা তো কোনো লেখাপড়া করনি, কোনোকিছু জান না।’ কথাটা একটি তরুণের মনে খুব লেগেছিল, নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। শেষে বলেই ফেললেন, ‘আমি স্কুল-কলেজে থাকতে যা পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পড়েছেন কি-না সন্দেহ।’

তরুণটির কথাটার পেছনে জোর ছিল। প্রমাণও ছিল। লিখেছিলেন ‘আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার গল্প। তিনি আহমদ শরীফকে সেদিনই জানালেন, তিনি নাটক লেখেন, পরদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর লেখা একটি নাটক প্রচারিত হবে। তাঁর বিশ্বাস, এরকম নাটক এর আগে খুব একটা হয়নি। কথাটি বলেই তাঁর মনে হলো, সর্বনাশ! কার সামনে কী বললেন তিনি। এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন।

পরের দিন বন্ধুরা তাঁকে বললেন, ‘শরীফ স্যার তোকে খুঁজছেন। এখনই দেখা করে আয়।’ শুনে আমর্ম কেঁপে উঠেছিলেন তরুণটি। কাঁপা কাঁপা বুকে অধ্যাপক আহমদ শরীফের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন তিনি। ভেতরে কাজ করছিলেন অধ্যাপক শরীফ, সালাম শুনে মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘তোমার নাটক দেখলাম। তোমার অহংকার সার্থক।’ বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। তরুণটি এক মূহূর্ত দেরি না করে ছুটতে শুরু করলেন। আর ছুটতে ছুটতে একটা বড় বাজিতে জিতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে বন্ধুদের এসে বললেন, ‘শরীফ স্যার নাটক দেখেছেন, স্যার বলেছেন, আমার অহংকার সার্থক।’ সেদিনের সেই তরুণটি হলেন বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যকার সেলিম আল দীন, যাঁকে নিয়ে এদেশের মানুষ অহংকার করে।

সেলিম আল দীন ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে পান কথাসাহিত্য পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে তিনি নান্দিকার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাটক রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি পান শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার পান ২০০১ সালে। সেলিম আল দীন বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানীয় পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন ২০০৭ সালে। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

তার উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহের মধ্যে রয়েছে, 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন' (১৯৭৫) 'বাসন' (১৯৮৫), 'মুনতাসির' , 'শকুন্তলা', 'কীত্তনখোলা' (১৯৮৬), 'কেরামতমঙ্গল' (১৯৮৮) 'যৈবতী কন্যার মন' (১৯৯৩), 'চাকা' (১৯৯১), 'হরগজ' (১৯৯২) 'প্রাচ্য' (২০০০), 'হাতহদাই' (১৯৯৭), 'নিমজ্জন' (২০০২), 'ধাবমান', 'স্বর্ণবোয়াল' (২০০৭), 'পুত্র' প্রভৃতি।

গীতিনৃত্যনাট্য : 'স্বপ্ন রজনীগণ', 'ঊষা উত্সব',

রেডিও-টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক : 'বিপরীত তমসায়' (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), 'ঘুম নেই' (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), 'রক্তের আঙ্গুরলতা' (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), 'অশ্রুত গান্ধার' (বিটিভি, ১৯৭৫), 'শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য' (বিটিভি, ১৯৭৭), 'ভাঙনের শব্দ শুনি' (আয়না সিরিজ, বিটিভি, ১৯৮২-৮৩), গ্রন্থিকগণ কহে (বিটিভি, ১৯৯০-৯১), 'ছায়া শিকারী' (বিটিভি, ১৯৯৪-৯৫), 'রঙের মানুষ' (এনটিভি, ২০০০-২০০৩), 'নকশীপাড়ের মানুষেরা' (এনটিভি, ২০০০), 'কীত্তনখোলা' (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫) ।

গবেষণাধর্মী নির্দেশনা :'মহুয়া' (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), 'দেওয়ানা মদিনা' (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), 'একটি মারমা রূপকথা' (১৯৯৩), 'কাঁদো নদী কাঁদো', 'মেঘনাদ বধ' (অভিষেক নামপর্ব)।

বিখ্যাত এই নাট্যকরের জন্মদিন উপলক্ষে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে প্রো-ভিসি অধ্যাপক নুরুল আলম (শিক্ষা), উপাচার্য অধ্যাপক শেখ মঞ্জুরুল হক সেলিম আল দীনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ গ্রামীণ থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশন, তালুকনগর থিয়েটার, শাব্যবানদল ঢাকা, সংগৃহীত সাংস্কৃতিক জোট, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, পপ্পেন্ট থিয়েটার রিসার্চ সেন্টার, টিচার অ্যান্ড স্টুডেন্ট সেন্টার (টিএসসি), কালমা থিয়েটার শহীদ তিতু থিয়েটার এবং সেলিম আল দীন মেমোরিয়াল সোসাইটি তার সমাধিস্থলে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। দুপুর ১২টায় ক্যাম্পাসের ওল্ড আর্টস ভবনে বারিন ঘোষের তোলা সেলিম আল দীনের জীবন ও কর্মের ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ।