মেরুদণ্ড সোজা রেখে বাংলাদেশ ছাড়েন যে সাংবাদিক
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। শুধু সে সময়ই নয়, বাংলাদেশের টানে তিনি বার বার ছুটে এসেছেন। এদেশের ১ম বেসরকারি পর্যায়ের টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালে তাঁকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়। যদিও তিনি এখনো বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে আছে অকৃত্রিম বন্ধ বন্ধু হিসেবে। আজ ১১ জানুয়ারি তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন সাইমন-
কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একাত্তর সালে সাইমন ড্রিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন সাংবাদিক। অন্যদিকে তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোর ৪০ সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। সেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন সায়মন ড্রিং।
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশক জুড়ে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেন। ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে নন্দিত হন তিনি। পেশাগত জীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেন। বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিও'র সংবাদ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছর। তিনি বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেন। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে লিখেছেন তিনি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে হোটেল রূপসী বাংলা) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফে পাঠান। যা ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টিতে এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৭১ সালে সরকার তাকে জোরপূর্বক পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়। ইংল্যান্ড থেকে একই বছরের নভেম্বরে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ওই দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সঙ্গে তিনি ঢাকায় আসেন।
একটি সূত্রের তথ্য, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। উলঙ্গ করে চেক করা হয় সাথে কী নিয়ে যাচ্ছেন! তার ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান গেলে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন না। তাই ব্যাংকক চলে যাওয়া স্থির করেন। ব্যাংকক থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠান ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’শিরোনামে। ৩০ মার্চ তা প্রকাশিত হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বহির্বিশ্বে প্রচারিত প্রথম সংবাদ। এই খবরটি ছাপা হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিদেশীদের টনক নড়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল।
সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবার এসেছিলেন ২০০০ সালে; এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর হিসেবে। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন ধারণার অন্যতম রূপকার। ১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে তিনি একুশে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেন। ২০০২ সালে সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনের কারণে চ্যানেলটি সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তিনি ও সহযোগী তিনজন নির্বাহী পরিচালক প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ওই বছর অক্টোবর মাসে সরকার তার ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে। এতকিছুর পরও মেরুদণ্ড সোজা ছিল সাইমনের। মাথানত করেনি কারো কাছে। অবশেষে ২০০২ সালের ১ অক্টোবর তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। যদিও আজও তিনি বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। দেশের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু তিনি।
কিন্তু কেন বন্ধ হয়েছিল সাইমন ড্রিংকের নিজ হাতে গড়া একুশে টেলিভিশন। যদিও এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আজ নেই। সাংবাদিক মামুন-উর-রশীদ লিখেছেন, রাত ১০টা ৪২ মিনিট। সংবাদ প্রযোজক শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম একুশে টিভির পর্দায় এলেন একটি বিশেষ বুলেটিন পাঠ করতে। পর্দায় এসে তিনি বললেন, সরকার মাইক্রোওয়েভ লিংকের মাধ্যমে স্যাটেলাইট সমপ্রচার এবং বিটিভির টাওয়ার ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করেছে। তাই আমরা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি বলেন, একুশে টেলিভিশন আপনার টেলিভিশন, কোটি কোটি মানুষের টেলিভিশন...। ‘শুভরাত্রি’ বলে তিনি যখন বিদায় নেন তখন ঘড়ির কাঁটায় ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট। ৪-৫ সেকেন্ডের জন্য ‘নো অর ব্যাড সিগন্যাল’ এই ম্যাসেজ ছিল পর্দায়। এরপর সাবিনা ইয়াসমিন এবং এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে “একুশের পাল তুলে” গানটি সম্প্রচার করা হয়। গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মামুন লিখেন, টিভি পর্দা তখন শুধুই ঝিরঝির। একুশের ৭ম তলায় তখন হাউমাউ কান্নার শব্দ। ওয়ার্কিং এরিয়ায় কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে কেবলি কাঁদছেন। আমি নিজেও কাঁদছি। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? আমাদের সবার প্রিয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. সাইমনড্রিংও কাঁদছেন। অঝোরে তার স্ত্রীও কেঁদে চোখ লাল করেছেন। মি. সায়মন নিজ হাতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলেন। তার হাতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠেছিল। দর্শকরা পেয়েছিল অনুষ্ঠান ও নতুন এক সংবাদমাধ্যম। তিনি আমাদের একে একে বিদায় জানালেন। মূলত এভাবে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর বাংলাদেশ ছাড়া।
অন্য দেশেও সুনাম কেড়েছে সাইমন
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দুই বার আহত হন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কিদের আগ্রাসনের সময়। ১৯৮৬ সালে লন্ডনে তিনি স্পোর্ট এইড নামের দাতব্য তহবিলের ধারণা তুলে ধরেন। স্যার বব গেল্ডোফের সাহায্যে ১২০টি দেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের অংশগ্রহণে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ৩৭ মিলিয়ন ডলার এই তহবিলে জমা হয়। ওই বছর দ্য রেস এসেইন্ট টাইম শিরোনামে অন্য আরেকটি দাতব্য তহবিল গড়েন সাইমন ড্রিং। এতে ১৬০টি দেশের প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’, ‘ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ’, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, ‘সনি’ ও ‘নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ’সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সন্মাননা লাভ করেন।
বর্তমানে তিনি স্ত্রী ফাইওনা ম্যাকফেরসনকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বসবাস করছেন। তাদের দুই যমজ কন্যা- আভা রোজ এবং ইন্ডিয়া রোজ। তার আগের সংসারে তানিয়া নামের এক মেয়ে আছেন।