বীরশ্রেষ্ঠদের ভিটা জরাজীর্ণ, সংগ্রহ নেই জাদুঘরগুলোতেও

সাত বীরশ্রেষ্ঠ; প্রত্যেকেই সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য।
সাত বীরশ্রেষ্ঠ; প্রত্যেকেই সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য।

বিজয়ের ৪৭ বছর পেরিয়ে ৪৮ বছরে পা রেখেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসের বিনিময়ে আজ সোনার বাংলা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো রাষ্ট্র। ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে আছেন সাত বীরশ্রেষ্ঠ। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠদের প্রায় সকলের পৈতৃক ভিটা জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্মৃতি জাদুঘরগুলোতে নেই উল্লেখযোগ্য কোনো সংগ্রহ। আর্থিক টানাটানিতে দিন কাটছে দুই বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের।

১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে প্রাণ দিয়েছেন মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, মোহাম্মদ হামিদুর রহমান, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং পরিবার ও স্মৃতিচিহ্নের বর্তমান অবস্থা কী, সেই জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে এ প্রতিবেদনে। 

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল
ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে শহীদ স্মরণীকা বাসায় বসবাস করছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগম। ৯৫ বছর বয়সী এ বৃদ্ধা শ্বাসকষ্ট, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপজনিত নানা রোগে ভুগছেন। সরকার থেকে মাসিক ভাতা পান ৯ হাজার টাকা।

মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে বিয়ে করেন মোস্তফা কামাল। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী পিয়ারা বেগমের গর্ভে সন্তান ছিল। সেই সন্তান সেলিম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি করছেন। মালেকা বেগম বলেন, সরকার থেকে বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানী ভাতা সাত হাজার ও পেনশন বাবদ দুই হাজার টাকা পাই। ওষুধ কেনা ও খাবার কেনায় এ টাকা খরচ হয়ে যায়। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস এলে সরকারের লোকজন এবং সাংবাদিকরা আমাদের খোঁজখবর নিলেও অন্য সময় কোনো খবর কেউ নেয় না। অর্থ-সম্পত্তি চাই না, শুধু আমরা কেমন আছি তার খবরর যদি কেউ নিয়মিত রাখেন তাতেই খুশি।

১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে মোস্তফা কামালের জন্ম। ১৯৮২ সালে রাক্ষুসী মেঘনা নদীতে ওই বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোলা শহরের আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে চলে আসে তাঁর পরিবার। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে ৯২ শতাংশ জমির ওপর একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। যার নাম দেওয়া হয় শহীদ স্মরণীকা। তখন থেকে এখানেই বসবাস করছেন তাঁরা। বর্তমানে বাড়িটির অবস্থা জীর্ণ।

রুহুল আমিন
নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার পূর্ব বাগপাচড়ায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পৈতৃক বাড়িটির অবস্থা বেহাল ও জীর্ণ। রুহুল আমিনের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৫ সালে মারা যান। ছোট ছেলে শওকত আলী জন্ম থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তিন মেয়ে নূরজাহান বেগম, রিজিয়া বেগম ও ফাতেমা বেগম চট্টগ্রামে বাস করেন। নোয়াখালীর বাড়িতে থাকেন ছোট ছেলে শওকত আলী এবং তাঁর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ও তাঁদের একমাত্র মেয়ে। শওকত আলীর একমাত্র আয় হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ ভাতা ও পেনশন থেকে পাওয়া ১০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তাঁর পরিবারকে চলতে হিমশিম খেতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে নৌবাহিনী শওকত আলীর বসবাসের জন্য ৪০ বছর আগে তিন কক্ষের একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করে দেয়। সেই থেকে শওকত আলী ওই বাড়িতে বসবাস করে আসছেন। বর্তমানে ওই দালানের ছাদ থেকে পানি চুইয়ে পড়ে। প্লাস্টার খয়ে গেছে। নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় শওকত আলীর পক্ষে এটি সংস্কার করাও সম্ভব হয়নি। রহুল আমিনের ছেলে শওকত আলীর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী সহজ সরল এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কোনো কাজ করেন না। ভাতার টাকা দিয়ে পরিবারের খরচ চলে। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজনরা সহযোগিতা করে থাকেন। তিনি আরো বলেন, বাড়ির সামনে বীরশ্রেষ্ঠের নিজের জায়গায় নির্মিত জাদুঘর ও পাঠাগার থাকলেও যাতায়াতের সড়কটি চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ায় দর্শনার্থীর সংখ্যা কম।

হামিদুর রহমান
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোর্দ খালিশপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের বাড়ি সংস্কারের অভাবে প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্মভিটায় একটি একতলা দালান বাড়িটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। হামিদুর রহমানের তিন ভাই তাঁদের পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন। খোর্দ খালিশপুর গ্রামে কলেজসংলগ্ন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে করা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি এখনো জাতীয়করণ হয়নি।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মেজো ভাই হামজুর রহমান বলেন, পরিবারের চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হামিদুর রহমান ছিলেন সবার বড়। এখন তিন ভাই দুই বোন জীবিত আছি। আমরা পাঁচ ভাই-বোন সবাই ভাতা পাচ্ছি। বাড়িটি সংস্কারের জন্য প্রশাসনের কাছে একাধিকবার আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

মতিউর রহমান
নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গ্রন্থাগারে অল্প কিছু বই থাকলেও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিচিহ্ন নেই। অবহেলায় জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে তাঁর পৈতৃক ভিটা। মতিউর রহমানের বাড়িতে কেউ থাকেন না। দরজায় ঝুলছে তালা। বাড়ির সামনে নতুন করে লাগানো হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যুবসংঘের সাইনবোর্ড। চারপাশের বাড়িগুলোতে থাকেন এ বীরশ্রেষ্ঠের স্বজনরা।

মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান বলেন, মতিউর রহমানের নামে গ্রামের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত থাকলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি। এটা বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকে ওনার স্মৃতিকর্ম দিয়ে সহযোগিতা করা হবে। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এনামুল হক বলেন, লোকজন আগ্রহ নিয়ে জাদুঘরে আসলেও তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে আশাহত হন। কিন্তু সহযোগিতা-অনুদান না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।

আবদুর রউফ
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের রউফনগর গ্রামে মধুমতী নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নদী তীরবর্তী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি এখন ভাঙনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। মুন্সী আবদুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্রেরিয়ান মুন্সী সাইদুর রহমান বলেন,এ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মারক নেই। দর্শনার্থীরা এসে স্মারক না দেখে মন খারাপ করে ফিরে যাচ্ছে। তাই এ জাদুঘরের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহ করা দরকার। নদীভাঙন থেকে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি রক্ষা করা জরুরি। তা না হলে নতুন করে এটি স্থাপন করা কঠিন হবে।

মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের বীরেেশ্রষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের জন্মভিটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এটি স্বজন ও স্থানীয়রা পরিত্যক্ত করেছে অনেক আগেই। এখন আর ওই ঘরের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু বলেন, আমরা বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের বসতঘরটিকে সংস্কার করার জন্য বহুবার আবেদন করেছি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাই যে ঘরটিতে দেশের একজন বীর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তা মেরামতে আমাদেরও প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি নেই।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মঞ্জুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করে। ওই জাদুঘরের অবস্থাও এখন করুণ। একজন কেয়ারটেকার জাদুঘরটি পরিচালনা করেন। জাদুঘরের অভ্যন্তরের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে আছে। ছয় মাস ধরে নেই কোনো পানির ব্যবস্থা। মঞ্জুর বলেন, সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে যেকোনো সময় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার, স্মৃতি জাদুঘর ও বসতভিটা বিলীন হয়ে যেতে পারে। তাঁর নামে করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিও ভাঙনের মুখে। কেবল আশ্বাসই দেওয়া হচ্ছে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার। তবে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

নূর মোহাম্মদ শেখ
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের নামে নড়াইলে গৃহীত নানা সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব উদ্যোগের অনেকটাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ২০০৮ সালে ‘মহিষখোলা’র নাম পরিবর্তন করে ‘নূর মোহাম্মদনগর’ নামকরণ করা হয়। তাঁর গ্রামে ঢোকার পথে নড়াইল-ঢাকা সড়কের পাশে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি না থাকায় নূর মোহাম্মদনগর এখনও লোকমুখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি।

গ্রামবাসীর সহায়তায় ২০০৫ সালে গড়ে উঠেছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় হতাশ এই কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। প্রায় ৩০০ ছাত্রের এই কলেজের একটিমাত্র টিনশেড ভবন, সিলিং না থাকায় এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে শব্দ যায় অবাধে। এতে করে নিয়মিত পাঠদানে অসুবিধা হয়। কলেজে নেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। গরমকালে ক্লাস করতে না পেরে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি চলে যায়। শিক্ষকরা দীর্ঘ ১২ বছর বিনা বেতনে কলেজে চাকরি করে যাচ্ছেন শুধু কলেজটি এমপিওভুক্ত হবে এই আশায়।

২০০৮ সালে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হলেও তাতে তেমন কোনো সংগ্রহ নেই। তবে গত বছর জাদুঘরে নূর মোহাম্মদের ব্যবহৃত একটি সাইকেল যুক্ত হয়েছে।

 


সর্বশেষ সংবাদ