রাজা রামমোহন রায়; ভারতীয় রেনেসাঁর জনক
ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক-ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীকরণ ও চিত্র পরিবর্তনে যাঁদের অবদান অসামান্য তার মধ্যে তিনি একজন। পণ্ডিত, সাহিত্যিক, বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ব্যাকরণবিদ সব ধরনের পদবি অলংকৃত করেছে তাঁর নামকে। সমাজ সংস্কারে অসামান্য অবদান রাখায় সম্রাটের কাছ থেকে পেয়েছিলেন রাজা উপাধি।অনেক ইতিহাসবিদ তাঁকে ভারতীয় রেনেসাঁর জনক মনে করেন।
বলছি ২০০৪ সালে বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জরিপে ১০ম স্থান অধিকার করা গর্বিত বাঙালি রাজা রামমোহন রায়ের কথা। ২২মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাজা রামমোহন। ১৭৭২ সালে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন রাজা। পিতা রামকান্ত ছিলেন বৈষ্ণব, মা ফুলঠাকুরানী দেবী ছিলেন শৈব। বর্ণপ্রথার প্রতি জানাশোনা তাই পরিবার থেকেই শুরু।
ভাষা শিক্ষা এবং ভ্রমণের প্রতি রায়ের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই তাই মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমণ করেন এবং ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। পাটনা থেকে আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন । কাশী ও নেপালেও গিয়েছিলেন তিনি। তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত তীর্থস্বামী কুলাবধূত সহযোগিতায় রামমোহন সংস্কৃত ভাষা শিখেন, বারাণসী থেকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়া বেদান্তের প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ। তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি মহাজনের কাজ করেছিলেন।পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী পদে যোগদান করেন।কোম্পানিতে যোগদানের ফলে কলকাতায় তিনি স্থায়ী হন।এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ফারসি ভাষায় লিখিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ তুহফাতুল মুহাহহিদিন। যা থেকে রায়ের একেশ্বরবাদের সমর্থনের ধারণা লাভ করা যায়।
রাজা রামমোহন সাহিত্যে অবদান রাখলেও সংস্কারক হিসেবে তার অবদান বেশি। সমাজের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন। বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়নকালে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার সম্পর্কে অবগত হন। অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত সতীদাহ বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি কলমী যুদ্ধ চালানোর পাশাপাশি এগুলো রোধে আইন প্রণয়নের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সতীদাহ ও বাল্যবিবাহ রোধে পার্লামেন্টারি আইন পাশের জন্য বিলেত গমন জরুরি ছিল, বিলেত যাওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা দান করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মোঘল সম্রাট ২য় আকবর তার দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৮৩০ সালে রামমোহনকে বিলেত পাঠান, মূলত রায়ের সাহসিকতা এবং দৃঢ় মনোবলের জন্য তিনি রামমোহনকে রাজা উপাধি দেন।
১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৮ দিন জ্বরে ভোগার পর ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আনসার ডেল' নামক স্থানে রাজার সমাধিস্থলে একটি মন্দির স্থাপন করেন। এছাড়া ব্রিস্টলে রাজার একটি মূর্তি ১৯৯৭ সাল থেকে এখনও বিদ্যমান।