অসহায় মানুষের কষ্টে কেঁদে ওঠে মেধাবী শিক্ষার্থী শান্তর প্রাণ
অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কষ্টে যার প্রাণ কেঁদে উঠে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এবং ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর ভালো একটি কাজের কথা ভাবেন। তিনি হলেন মো. ফেরদৌস শান্ত। শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার বাছুর আলগা গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। শৈশবকালও কেটেছে গ্রামে স্নিগ্ধ শোভন পরিবেশে। পিতা মো. হোসেন আলী পেশায় চাকুরিজীবী, মাতার মোছা. জাহানারা বেগম পেশায় গৃহিণী। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে শান্ত সবার বড়। তিনি ২০১৫ সালে চন্দ্রকোনা রাজলক্ষী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করেন।
উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ২০১৭ সালে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হয়ে এবং ২০২১ সালে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করে বর্তমানে ২০২১-২২ সেশনে স্নাতকোত্তর এ অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ডার্মস্ট্যাড থেকে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সে ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ পান। একইসঙ্গে জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি বার্গকাডেমি ফ্রেইবার্গ থেকেও ম্যাটেরিয়াল এনালাইসিস বিষয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ পান।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ক্লাব ও সংগঠনের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। এরই ধারাবাহিকতায় ফিজিক্স ক্যারিয়ার এন্ড রিসার্চ ক্লাব, মাভাবিপ্রবি-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা, মাভাবিপ্রবি-এর সাবেক সভাপতি, শেরপুর জেলা ছাত্র সংসদ, মাভাবিপ্রবি-এর সাবেক সভাপতি এবং ফিজিক্স সোসাইটি-এর সহ-সভাপতি দায়িত্বও পালন করেন।
বিভিন্ন সময়ে তাকে দেখা যায় টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর দায়িত্ব নেওয়া, খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষের শীত নিবারণের জন্য কম্বল বিতরণ, বানের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, পড়াশোনা করতে প্রবল আগ্রহী দারিদ্র্য শিক্ষার্থীর খরচ বহনের ব্যবস্থা করা, ঝড়ে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া মানুষদের কাছে বাজার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ও তাদের সময় দেওয়া, রাস্তায় থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন নগ্ন ও ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে অন্ন-বস্ত্র দান, গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে তৃষ্ণার্ত পথচারীদের খাবার পানি ও স্যালাইন দানের মতো মহৎ কাজগুলো করতে।
এই সকল মহৎ কাজে কার অনুপ্রেরণায় আসেন তা জানতে শান্তর সঙ্গে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকের। শান্ত বলেন, “ছোটবেলা থেকে দেখতাম আমার বাবা- মা সবসময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতো। সবসময় তারা মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করতো। বাবা-মা ই আমার ভালো কাজের অনুপ্রেরণা, তাদেরকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে ভালো কাজ করা শুরু করি।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সবসময় মানুষের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি তাদের সেমিস্টার ফি’র ব্যবস্থা করে দিয়ে, কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ দিয়ে, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের খাদ্য-বস্ত্র দিয়ে, বন্যার্ত মানুষদের মধ্যে ত্রাণ-সামগ্রী দিয়ে, শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র দিয়ে, এতিম শিশুদের শিক্ষাসামগ্রী-প্রয়োজনীয় বস্ত্র দিয়ে, তীব্র গরমে রাস্তায় শ্রমজীবী মানুষদের পানি-স্যালাইন দিয়ে, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে সহযোগিতা, শিক্ষার্থীদের ঋণ পরিশোধে সহায়তা করেছি। ২০২২ সালে যখন সিলেটে বন্যা হলো তখন আমার উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে ৪ লাখ টাকার অধিক ফান্ড কালেকশন করে সিলেটে আমরা ৭০০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে এসেছি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। মানুষের কাছে জীবনের সফলতা মানেই ভালো একটা চাকুরি অথবা এককথায় বলতে গেলে বেশি বেশি টাকা উপার্জন করা। তবে কাছে সফলতা জিনিসটা একটু ভিন্ন। আমি নিজেকে সেইদিন সফল মনে করবো যেদিন প্রথমে আমার বাবা-মার নাম একটি ফাউন্ডেশন খুলবো যার নাম হবে “জাহানারা-হোসেন ফাউন্ডেশন”। এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে আমার গ্রামে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও মানুষের জন্য একই জায়গায় একটি এতিমখানা, একটি স্কুল ও একটি হাসপাতাল তৈরি করার ইচ্ছে যদি আল্লাহ তায়ালা চান। আমার নিজ গ্রামসহ আশেপাশের অন্যান্য গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও দরিদ্র মানুষরা এতিমখানা, স্কুল ও হাসপাতাল থেকে সেবা নিবে। যেদিন আমি এই কাজ গুলো করতে পারবো সেদিন নিজেকে সফল মনে করবো।
তিনি আরও বলেন, আগে অবসরে ছোটবেলায় ক্রিকেট, দাবা, ক্যারাম খেলতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু বর্তমানে খুব একটা অবসর টাইম পায়না। সবসময় ৫ থেকে ৬ টা টিউশন করাই, যার কারণে অবসর সময় পায়না বললেই চলে। ব্যস্ত সময়ের মাঝেও যদি কিছু সময় পাই তাহলে ভালো কাজ করার চেষ্টা করি। মূলত টিউশনের টাকা থেকেই ভালো কাজগুলো করি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুইজন এতিম শিশুর প্রয়োজনীয় পোশাক, শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ এর সরবরাহ করি। এক্ষেত্রে আমার সাথে অনেকেই বিভিন্ন সময় যুক্ত থাকে। সর্বোপরি সবসময় মানুষের উপকারে আসার চেষ্টা করেছি, কারো বিন্দুমাত্র ক্ষতিকরার চেষ্টা করিনি।