শিক্ষাবিদ, দক্ষ প্রশাসক কিংবা বরেণ্য গবেষক— সবই মানানসই ড. এম রিজওয়ান খানের সঙ্গে
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম রিজওয়ান খান। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি- ইউআইইউ’র সাবেক উপাচার্য। দায়িত্ব পালন করেছে টানা তিন মেয়াদে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে শিক্ষকতা ও গবেষণায় যুক্ত গুণী এ অধ্যাপকের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েটে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত আরইআরইডিডি প্রকল্পধীন ‘সৌর হোম সিস্টেম’ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তাঁর। শিক্ষকতা-গবেষণা ও নেতৃত্বের ফলস্বরূপ ঝুলিতে যোগ করেছেন একের পর এক নানা পুরস্কার ও সম্মান।
ড. এম রিজওয়ান খানের জন্ম ১৯৫৭ সালে। রাজধানী ঢাকায়। বাবা মোহাম্মদ ফেরদাউস খান ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। সবশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় শিক্ষা কমিশন (কুদরত-ই-খুদা কমিশন)-এর সদস্য সচিব হিসেবে। শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্য অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, ১৯৮০ ও বাংলা একাডেমি ফেলোশিপও পেয়েছিলেন ‘ছয় পিএইচডি হোল্ডার’ ও চার বুয়েট অধ্যাপকের এই বাবা।
নয় ভাই-বোনের মধ্যে বাড়িতে বেড়ে ওঠা ড. রিজওয়ানের পারিবারিক অবস্থান সপ্তম। পরিবারের মাঝ সন্তান হওয়ায় অবশ্য খানিকটা অম্ল-মধুর আক্ষেপও আছে তাঁর। দক্ষ এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকের ভাষায়, ‘ব্যপারটা এমন যে— বাবা-মা ছাড়াও তার ওপর খবরদারিত্ব করার জন্য আরও ৬ জন লোক রয়েছেন। অনেক সময় স্কুলে কিছু না পারলে যতটা না বেশি মা-বাবা বকা দিতেন; তার চেয়ে বেশ দিতেন ভাই-বোনেরা।’ কে জানত, সেই শাসন-অনুশাসনই তাকে আজ লাখো কোটি মানুষ থেকে স্বতন্ত্র্য বানিয়েছে। ছোটবেলায় চিন্তা ও মন-মননে বেশি অন্তরাভিমুখী ছিলেন এম রিজওয়ান। যদিও তাতে দুরন্তপনায় ভাটা পড়েনি একটুও। সেই দুরন্তপনায় একবার নিজের মাথাও ফেটেছিল; যে স্মৃতি এখনও নাড়া দিয়ে যায় ষাটোর্ধ্ব এই অধ্যাপককে।
বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী ইউআইউ-তে অধ্যয়নরত। এই সংখ্যা দিয়ে ইউআইউকে মূল্যায়ন করতেও নারাজ এই অধ্যাপক। তার মতে, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হলেই তাকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালো করছে কি না, গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি পাচ্ছে কি না— সে বিষয়গুলোও মানদণ্ডে আনতে হবে।
এম রিজওয়ানের শিক্ষাজীবন শুরু রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল দিয়ে। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ ও এরপর বুয়েট। স্নাতক করেছেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) থেকে। বর্তমানের অধিকাংশ গবেষণা এই বিষয়কে ঘিরেই। দেশসেরা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে পড়লেও এম রিজওয়ানের মন পড়ে ছিল বাবার পড়ুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানে। গবেষণার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকেই এই বিভাগে পড়াv ইচ্ছে ছিল তাঁর। যদিও পরিবারের পরামর্শ ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।
আরও পড়ুন: চাকরির বাজারে ‘ডে ওয়ানে’ কাজ পাবেন ইউআইইউ স্নাতকরা
দেশের পাশাপাশি বিদেশের পড়ালেখাতেও বেশ কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন অধ্যাপক রিজওয়ান। শিক্ষাজীবনের সেই স্মৃতি আওড়িয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম এই গবেষক বলেন, ‘বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করার পর ১৯৮২ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে মাস্টার্স করতে যাই। এমএসসি'র রেজাল্ট ভালো হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন অধ্যাপক সেখানেই পিএইচডি করার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে সেখানেই আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়।’ এমএসসি এবং পিএইচডি— সবমিলিয়ে সাড়ে চার বছরের বেশি সময় যুক্তরাজ্যে কাটান এম রিজওয়ান খান।
ব্যক্তিজীবনে বরাবরই গবেষণা ও শিক্ষকতার মধ্যে থাকতে চেয়েছিলেন অধ্যাপক রেজওয়ান। যে ইচ্ছা পূরণে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন সবসময়। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন বুয়েটের স্নাতক ফলে। স্বভাবতই কর্মজীবনটা শুরু হয়েছিল বুয়েট দিয়েই। ১৯৮০ থেকে ২০০০— প্রভাষক থেকে সহকারী-সহযোগী ধাপ পার হয়ে অধ্যাপক, ড. রিজওয়ানের মোট শিক্ষকজীবনের ২০ বছরই কেটেছে এই বুয়েট প্রাঙ্গণে।
গল্পে-আলাপে বললেন, পড়ালেখা শেষ করার পর বুয়েটে চাকরি পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। ফলাফল ভালো হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারেও ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তাঁর ভাষায়, ‘স্নাতকের ফল প্রকাশের পর কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম, বুয়েটে চাকরিটা আমার হবে। কেননা মোট ৪ জন শিক্ষক নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে দ্বিতীয় হওয়ায় অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম। তাই বুয়েট শিক্ষক হওয়ার পরও বড় কোনো উদযাপন করা হয়নি।’
আরও পড়ুন: যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি একশ’ শিক্ষার্থীর ৮ জন পড়েন বিনা খরচে
২০০৪ সালে বুয়েট থেকে শিক্ষাছুটি নিয়ে বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় ইউআইইউ-তে যোগ দেন অধ্যাপক রিজওয়ান। দায়িত্ব পালন শুরু করেন স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিন হিসেবে। দীর্ঘ এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পান ২০০৫ সালের ১৬ মার্চে; যা তিন মেয়াদ পার হয়ে ১৩ নভেম্বর ২০১৭-তে শেষ হয়।
নিজ গবেষণার পাশাপাশি যখন যে দায়িত্বে পেয়েছেন, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তখনই তা পালনের চেষ্টায় ব্রত ছিলেন ড. এম রিজওয়ান খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণার মান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন জানিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, ‘ইউআইইউ ভালো করছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে।’ আগামী ১০ বছরে ইউআইইউকে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে
ছাত্রজীবনে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করার সুযোগ পেলেও তা করা হয়নি অধ্যাপক এম রিজওয়ান খানের। এ নিয়ে পরিবার থেকেও ছিল নিরুৎসাহ। ‘বুয়েটে পড়াকালীন টিউশনির সুযোগ ছিল। তবে মা-বাবা তা সাপোর্ট করেননি। তাদের যুক্তি ছিল, ভালোভাবে পড়ালেখা করলে জীবনে অনেক অর্থ উপার্জনের সুযোগ আসবে। মূলত সেই পরামর্শের কারণেই কখনো টিউশনি করা হয়ে উঠেনি'— যোগ করেন এম রিজওয়ান।
ইউআইইউ’র সবুজ প্রান্তরে চলতে চলতে নিজের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গল্প বলার পাশাপাশি ভালো ছাত্রের বৈশিষ্টের কথাও শুনিয়েছেন এই অভিজ্ঞজন। তার অভিমত, ‘শুধু ফলাফল কখনো ভালো শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সিজিপিএ বেশি হলেই তাকে ভালো বলা যাবে না। একজন ভালো শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সেই সঙ্গে ভালো চরিত্রের অধিকারীও হতে হবে। অন্যদিকে তুলনামূলক কম ভালো শিক্ষার্থীদের অপছন্দ করা যাবে না। তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে অনুযায়ী তাকে কাজ দিতে হবে।’
দীর্ঘ ৪৪ বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনে অনেক ট্রাজেডি দেখেছেন অধ্যাপক এম রেজওয়ান খান। যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে এ অধ্যাপকের এক সহকর্মী আমেরিকায় গিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেই ঘটনা এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। মধুর গল্পের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ১৯৯২ সালে সেরা প্রেজেন্টেশন পুরস্কার পাওয়ার কথা মনে পড়ে যায় তার। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটা কনফারেন্সে একটা পেপার প্রেজেন্টেশনে গিয়েছিলাম। সেখানে সেরা প্রেজেন্টার এবং সেরা টেকনিক্যাল পেপারের পুরস্কার পেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি স্থানে প্রথমবার গিয়ে একসঙ্গে দুটো পুরস্কার নিয়ে আসা অনেক বড় পাওয়া ছিল।’
ইউআইইউ-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক রেজওয়ান। শিক্ষকতা এবং গবেষণা দুটো দায়িত্ব সমানভাবে পালন করে যাচ্ছেন। ইউআইইউ-এর বর্তমান অবস্থানের কৃতিত্ব দিতে চান পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদকে। বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী ইউআইউ-তে অধ্যয়নরত। এই সংখ্যা দিয়ে ইউআইউকে মূল্যায়ন করতেও নারাজ এই অধ্যাপক। তার মতে, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হলেই তাকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালো করছে কি না, গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি পাচ্ছে কি না— সে বিষয়গুলোও মানদণ্ডে আনতে হবে।
প্রশাসনিক দায়িত্বের চেয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষকের দায়িত্ব বেশি উপভোগ করেন এম রিজওয়ান খান। গত ২০ বছর ধরে কাজ করছেন এনার্জি ও রিনিউএবল এনার্জি সেক্টরের উন্নয়নে। বিষয়টি নিয়ে এক সময় নানামুখি চ্যালেঞ্জে পড়লেও বর্তমানের উন্নয়ন নানাভাবে আন্দোলিত করে এই গবেষককে। ‘যখন রিনিউএবল এনার্জি নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন কী ধরনের উৎস ব্যবহার করব সেটি নির্ধারণ করা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ শুরু করতে হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধা এসেছে, সবকিছু মোকাবেলা করেই রিনিউএবল এনার্জি আজ এতদূর এসেছে। এই যে আমরা সাধারণ চুলার চেয়েও সাশ্রয়ীভাবে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে রান্না করতে পারছি— এটা নিঃসন্দেহে আমার, আমাদের জন্য খুশির, আনন্দের।’
নিজ গবেষণার পাশাপাশি যখন যে দায়িত্বে পেয়েছেন, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তখনই তা পালনের চেষ্টায় ব্রত ছিলেন ড. এম রিজওয়ান খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণার মান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন জানিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, ‘ইউআইইউ ভালো করছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে।’ আগামী ১০ বছরে ইউআইইউকে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে— এমন প্রত্যয়ই এখন ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা মানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার এই কারিগরের।