১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:১৪

গুরুতর অসুস্থ কবি সরোজ দেব, চলছে কেমোথেরাপি

গুরুতর অসুস্থ কবি সরোজ দেব  © টিডিসি ফটো

গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ষাট দশকে উত্তরাঞ্চলের লিটলম্যাগ আন্দোলনের পুরোধা কবি সরোজ দেব (৭৩)। মূত্রথলি থেকে টিউমার অপসারণের পর তাকে দেওয়া হচ্ছে কেমোথেরাপি।

অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। যেটুকু চিকিৎসা হচ্ছে তা শুভাকাঙ্ক্ষীদের টাকায়। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় বর্তমানে কবির দিন কাটছে দুঃখ-কষ্ট আর অনাহারে।

বুধবার (১৭ জানুয়ারি) গাইবান্ধা পৌরশহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার ঐশী ক্লিনিকেরর বিছানায় অসহায় কবিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। নির্বাক কবির দুচোখে আজ শুধুই হতাশা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৫ ডিসেম্বর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে গাইবান্ধা শহরের নিজ মালিকানাধীন ঐশী ক্লিনিকে ভর্তি করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বিপ্লব। পরে শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ২৮ ডিসেম্বর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কবির মূত্রথলি থেকে টিউমার অপসারণ করা হয়। 

চিকিৎসাধীন কবি সরোজ দেব বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ জাহান আফরোজা লাকীর তত্ত্বাবধানে আছেন। রোববার (১৪ জানুয়ারি) তাকে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য রংপুর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার (১৫ জানুয়ারি) কবিকে রংপুর নেয়া হবে।

কবি সরোজ দেব ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ উপেন্দ্র নাথ দেব ও মাতা সান্তু দেব।

স্কুল জীবনেই সরোজ দেবের কাব্যিক প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। পরে কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। শুরু করেন ‘শব্দ’ সম্পাদনা। কলেজ জীবন থেকেই ‘শব্দ’ সম্পাদক হিসেবে নাম অর্জন করেন তিনি। একটানা ৫৬ বছর ‘শব্দ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও স্বজন শব্দাবলী, প্রাণেশ্বরীর মাচান, বজ্রে বাজে বেণু, লাল গোলাপের জন্য, শতদল, মোহনা, সংশপ্তক, শতাব্দী, নান্দনিক ইত্যাদি বিভিন্ন নামে দেড় শতাধিক সাহিত্য পত্রিকা বা লিটলম্যাগ বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন। ষাট দশক থেকে তার পদচারণায় মুখরিত ছিল গাইবান্ধার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সূর্যকণা’ তার হাতেই গড়া।

সরোজ দেব ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সরোজ দেব দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও গড়েছেন একাধিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সরোজ দেব স্কুল জীবন থেকে কবিতা লেখা শুরু করলেও তার কবিতার বই বেরিয়েছে অনেক পরে। তার রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে, ধবল মেঘের দিনগুলো (২০০৬), অনন্ত রোদ্দুরে এসো (২০০৯), স্বরচিত সুখের সৎকার (২০১০), স্বপ্ন শুয়েছিল কুয়াশায় (২০১১) ও সময় আমাকে হত্যার কথা বলে গ্যাছে (২০১৩)।

আরও পড়ুন: নতুন শিক্ষামন্ত্রীর রাজনৈতিক-শিক্ষাগত পরিচয়

এছাড়া তিনি অনেকগুলো গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন। সেগুলো হলো, রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার গল্প (২০০৬), শরৎচন্দ্রের ভালোবাসার গল্প (২০০৬), কবিতার যৌথ খামার (২০০৯), নির্বাচিত কবিতা (২০১২) ও ছোটদের শরৎচন্দ্র (২০১২)।

সরোজ দেবের সহচর গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমির যুগ্ম-সম্পাদক অমিতাভ দাস হিমুন বলেন, কবি সরোজ দেব শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতের বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে কবি সরোজ দেবের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তাকে আমাদের মাঝে আরো দীর্ঘদিন প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কবিকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার দাবি জানান তিনি।

কবির আরেক সহচর গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সাহিত্য সম্পাদক গৌতমাশিষ গুহ বলেন, সাহিত্য অঙ্গনে গাইবান্ধার অনেক প্রজন্ম কবি সরোজ দেবের হাত ধরে তৈরি হয়েছে। তিনি সারাজীবন এ কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কখনো কোনো চাকরি করেননি। কবির পরিবারে আয় করার মতো কেউ নেই। এক ছেলে আছে সে-ও বেকার। বর্তমানে অর্থাভাবে দুর্বিসহ দিন কাটছে মহান এ মানুষটির। গাইবান্ধাবাসী তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সবার উচিৎ তার পাশে দাঁড়ানো।

এর আগে কবিকে দেখতে আসেন গাইবান্ধা জেলা প্রাশাসক (ডিসি) কাজী নাহিদ রসুল। সঙ্গে ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসান।

এসময় জেলা প্রশাসক কবির চিকিৎসার সার্বিক খোঁজ-খবর নেন। নগদ ৫০ হাজার টাকা অর্থসহায়তা প্রদান করেন। সেইসঙ্গে নির্ধারিত মাসিক সহায়তা ১৫ হাজার টাকাসহ পরবর্তীতে আরও ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন।

কথা হয় গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবি সরোজ দেবকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।