অবসরের ২০ বছর পরও স্কুলে ক্লাস নেন ভারতের এই শিক্ষক
ছুটিতেও ‘ছুটি’ নেই এই শিক্ষকের। একাশি বছর বয়সেও যেন চির তরুণ তিনি। অবসরের দীর্ঘ কুড়ি বছর পরেও রোদ, বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে প্রতিদিন ঠিক সকাল সাড়ে দশটাতেই স্কুলে পৌঁছে যান। আজকের দিনে যখন আদর্শ শিক্ষকের মাপকাঠি নিয়ে হইচই হয়, তখন ইনি যেন নির্বিকার। তিনি বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। জগদ্দলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজও সমান দক্ষতায় ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
১৯৬২-তে সামান্য বেতনে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন বাসুদেব বাবু। ৯৭-তে বাঁকুড়া-১ ব্লকের সেই জগদ্দলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তারপরেও সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের ছেড়ে একদিনের জন্যও বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি এই মানুষটি। রবিবার আর সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ফুল হাতা পাঞ্জাবি, আর পায়ে সস্তার এক জোড়া চপ্পল জুতো পরে হাজির হয়ে যান স্কুলে। তারপর মাঝে টিফিনের সময় টুকু বাদ দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত এক নাগাড়ে চলতে থাকে স্কুলের ছোটো ছোটো শিশুদের প্রথম অক্ষর চেনানোর কাজ।
শিক্ষকতার পাশাপাশি বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সঙ্গীতজ্ঞও। তিনি এক সময় বিষ্ণুপুর ঘরাণার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ধ্রুপদ শিখেছিলেন। পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি আর ভক্তিগীতিতেও সমান পারদর্শী। সঙ্গীতেও তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। অক্লান্ত এই শিক্ষক তাঁর দীর্ঘদিনের চেষ্টায় এলাকায় ‘স্কুল ছুটে’র সংখ্যা একেবারে ‘শূন্য’তে নামিয়ে এনেছেন। সেই সব ‘স্কুল ছুট’ ছাত্র ছাত্রীদের স্কুলে টেনে আনতে প্রয়োজনে বাড়ি গিয়ে কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সঙ্গে। বুঝিয়েছেন সরকার যেখানে বই, খাতা, পোশাক, ব্যাগ থেকে মিড-ডে-মিল সব দিচ্ছে। সেখানে ছেলে মেয়েরা কেন স্কুলে যাবেনা। শিক্ষা ছাড়া এই সমাজে কোনও দাম নেই। কেন অবৈতনিক এই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থাকবে শিশুরা। সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই শিক্ষকের কথা ফেলতে পারেননি কেউই। অভিভাবকরাই নিজেদের উদ্যোগে ছেলে মেয়েদের নিয়মিত স্কুলে পাঠিয়েছেন ও পাঠাচ্ছেন।
জগদ্দলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক্ প্রাথমিক থেকে চতুর্থ শ্রেণী মিলিয়ে বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা ২৩০। শিক্ষক সংখ্যা পাঁচ। যদিও এই মুহূর্তে দু’জন শিক্ষক বিপুল সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীদের পাঠদান করছেন। কারণ একজন শিক্ষিকা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। আরও দু’জন নির্বাচন সংক্রান্ত বিশেষ কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন। ফলে এই পরিস্থিতি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বাসুদেব বাবু সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ায় অন্যান্য শিক্ষকদের পক্ষে অনেকটাই সুবিধা হয়েছে।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বরূপ গরাই বলেন, ‘বাসুদেব বাবু আমাদের কাছে অভিভাবক স্থানীয়। ওনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। শিখছিও। ওনার যে সময়ানুবর্তিতা তা সব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যখন শিক্ষকদের উপস্থিতি ক্ষেত্রে এস.এম.পদ্ধতি বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে তখন এই সব মানুষ সেক্ষেত্রে তা দৃষ্টান্ত। ওনার মতো শিক্ষক থাকলে এসব প্রয়োজন পড়বেনা। উনি দীর্ঘকাল অবসর গ্রহণের পরও বিনাপারিশ্রমিকে যেমন স্কুলে পড়াচ্ছেন তেমনি ঘড়ির কাঁটা মেনে সঠিক সময়ে প্রতিদিন স্কুলে আসেন।’
শিক্ষক বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাড়িতে নিত্যকালী পুঁজো হয়। তিনি যেমন দেবতা। তেমনি এই স্কুল আমার কাছে মন্দির। স্কুল আর এই কচিকাঁচাদের ছেড়ে বাড়িতে থাকলে দমবন্ধ হয়ে যায় বলেও তিনি জানান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষাদান করে যেতে চান বলে বাসুদেব বাবু জানান।
বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাজে খুশি সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরাও। অবসরের দীর্ঘ কুড়ি বছর পরেও এভাবে নিজের স্কুল ও ছাত্র ছাত্রীদের ভালোবেসে এভাবে স্কুলে পড়ানোর ঘটনা খুব একটা চোখে পড়েনা বলেও অনেকে জানিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে গ্রামবাসীদের গর্বের শেষ নেই। বাবা, ছেলে, নাতি। এই তিন প্রজন্মের একজন শিক্ষক বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন অজস্র নজির বাঁকুড়ার জগদল্লা গ্রামে অনেক অনেক আছে বলে গ্রামবাসীরা জানালেন।
সূত্র: কলকাতা ২৪/৭