কয়েক শ স্প্লিন্টার শরীরে, চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তা
একটু হাঁটলেই পা ফুলে যায় রাজিবুল ইসলামের। ঠিকমতো বসতেও পারেন না। শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক শ স্প্লিন্টার। পরিবারের আশঙ্কা, সঠিক চিকিৎসা না পেলে ধীরে ধীরে হয়তো স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন তিনি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করার সময় গত ৮ এপ্রিল রাতে পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে আহত হন তিনি।
রাজিবুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সেদিন শটগানের গুলিতে আহত হওয়ার পর বন্ধুদের সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন তিনি। তখনো বুঝে উঠতে পারেননি তাঁর শারীরিক আঘাত কতটা গুরুতর। পরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করান তিনি। শরীরে কয়েক শ স্প্লিন্টার বিদ্ধ হওয়া রাজিবুলকে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
রাজিবুলের বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবার ব্যবসার কারণে তাঁদের পরিবার থাকে সাভারের ইসলামনগরে। সেখানে একটি ওষুধের দোকান (ফার্মেসি) রয়েছে তাঁর বাবা আবদুস সালামের। এই দোকানের আয় দিয়েই সংসার চলে তাঁদের।
রাজিবুলের বাবা আবদুস সালাম বলেন, তাঁর বড় ছেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তিন মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুজন পড়াশোনা করছেন। রাজিবুলকে নিয়েই তাঁর বড় আশা। কিন্তু ছেলেটা ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা তাঁর। ঠিকমতো চলাফেরাই করতে পারেন না। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিলেও ছেলেকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাঁর নেই।
রাজিবুলের পরিবার জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকার কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
আহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাজিবুল বলেন, সেদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনরত অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি চারুকলা অনুষদের সামনে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ পুলিশ ধাওয়া দিলে দৌড় দেন তিনি। একটু পরই অনুভব করেন তাঁর পা ও কোমরে কিছু একটা লেগেছে। হাত দিয়ে দেখেন রক্ত। কোনোমতে চারুকলার ভেতরে গিয়ে আছড়ে পড়েন। পরে কয়েকজন বন্ধু তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান।
রাজিবুল বলেন, ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান তিনি। পরদিন মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে এক্স-রে করান। এক্স-রে পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর পা ও কোমরে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিঁধেছে। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন, অস্ত্রোপচার করে এত স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব নয়। এতে পায়ের অসংখ্য রগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে জোগাড় হবে, এ নিয়ে চিন্তিত তিনি।
রাজিবুল যেদিন (গত ৮ এপ্রিল) আহত হন, সেদিন গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আশিকুর রহমানও। গুলিতে তাঁর যকৃৎ ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো তাঁর শরীরের ভেতরে রয়ে গেছে গুলিটি। আশিকুরের বন্ধুরা জানান, ৮ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ কোটা আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে গুলিবিদ্ধ হন আশিকুর। এ ছাড়া পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. শাহরিয়ার হোসেন। তাঁর পিঠে আটটি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। আর ৯ এপ্রিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে চোখে আঘাত পান কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরেফিন। তাঁর চোখে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। এখনো চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তিনি। এর বাইরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতুড়ি ও লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম।
কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক আন্দোলনের সময় তাঁদের বলেছিলেন, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও একই আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো কোটা আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে (ঈদের আগে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন) নেওয়া হয়।
সূত্র: প্রথম আলো