হারিকেন জ্বালিয়ে পড়া রকিবুল এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
দিনের বেলায় কাদাপানিতে খেলাধুলা। রাতে হারিকেন বা কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসা, এই ছিল এস এম রকিবুল হাসানের রুটিন। আশপাশের কারও পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ ছিল না। খেলার মাঠের অভাব ছিল না, খেলার সাথিও জুটে যেত অনায়াসেই।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার রায়পুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হয়েছে রকিবুলের ছেলেবেলার পড়াশোনা। গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসতেন রকিবুল। নামী কোনও স্কুল ছিল না। শিক্ষকের সংখ্যাও হাতে গোনা। সেই রকিবুল এখন যুক্তরাষ্ট্রের মার্সার ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
নতুন ওষুধের মাধ্যমে কীভাবে রক্তনালির ত্রুটি সংশোধন করা যায় এবং উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ঠেকানো যায়, সেই গবেষণা করছেন তিনি। গত বছর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ থেকে পেয়েছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার বা ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার অনুদান। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে বিশেষ ফেলোশিপ পেয়েছেন। মেধার বিচারে রকিবুলের গবেষণা সেরা পোস্টার হিসেবে দেখানো হয়।
মাধ্যমিকে উচ্চতর গণিত কঠিন মনে হতো। পরীক্ষার ছয় মাস আগে এক শিক্ষকের খোঁজ পান। তাঁর কাছে যাওয়া-আসাতেই চার-পাঁচ ঘণ্টা কেটে যেত। এভাবে তিন মাস পড়ার পর গণিতের ভয় কেটে গেল। মাধ্যমিকে ছয় বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে ১৯৯৯ সালে পাস করেন রায়পুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ শেষ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে যান ফার্মাসি বিভাগে। রকিবুল বলেন, গ্রামে কোনো লাইব্রেরি ছিল না। লাইব্রেরির দেখা পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। বাবা মো. আবদুল হান্নান শাহ ছিলেন রায়পুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শহরে গেলে বই নিয়ে আসতেন। ওইটুকুই ছিল পড়ার সুযোগ।
আরো পড়ুন: চাকরি খোঁজার বয়সেই চাকরি দিচ্ছেন ইউএপি’র আদর
জাবির ফার্মাসি বিভাগ থেকে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’ কথা তাকে পেয়ে বসে। হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে বিপণন নির্বাহী হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ৯ মাস পর শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকতে প্রথমে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং পরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
রকিবুল বলছিলেন, ব্র্যাকে ল্যাব স্থাপন করে ইঁদুরের ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছি। এই সময়েই গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য আবেদন করতে শুরু করি। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে শিক্ষাবৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পান।
বাংলাদেশের বহু মানুষ হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণে মারা যায়, এ নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন রকিবুল। ২০১৬ সালে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে গবেষণার জন্য অনুদান দেয়। বাবা শিক্ষক বলেই শিক্ষকতার সুযোগই খুঁজছিলেন রকিবুল। সে সুযোগ হয় ২০১৮ সালে, জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের মার্সার ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগে যোগ দেন তিনি। গবেষণার জন্য নিজস্ব ল্যাব স্থাপন করেন। মাস্টার্স ও পিএইচডির শিক্ষার্থীদের গবেষণা তত্ত্বাবধান করছেন। পাশাপাশি ডক্টর অব ফার্মাসির শিক্ষার্থীদের পড়ান।
রকিবুলের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের সংখ্যা ৫২। তাঁর প্রতিবেদনকে সাইটেশন করা হয়েছে দেড় হাজারের বেশি প্রবন্ধে। রকিবুল বলেন, সব সফলতার জন্য আমার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র মনে গেঁথে দিয়েছেন তিনি। মা রহিমা বেগমও উৎসাহ দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানান স্ত্রী স্নেহা এবং ছেলে আরীবকে।