গুজবনাশের মেশিন ‘বিডি ফ্যাক্টচেক’

বিডি ফ্যাক্টচেক লোগো এবং প্রতীকি ছবি
বিডি ফ্যাক্টচেক লোগো এবং প্রতীকি ছবি  © টিডিসি ফটো

"চীনের উহান থেকে একজন ভারতীয় জানিয়েছেন, সেখানে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে কোনো প্রকার ঔষধ বা চিকিৎসা নিচ্ছেন না। বরং উহানবাসী গরম পানির ভাপ নিচ্ছেন, গরম পানি পান করছেন এবং গরম চা পান করছেন। ভারতীয় ওই ব্যক্তি জানান, শুধু এই তিন কাজে আপনিও করোনার বিনাশ সাধন করতে পারেন।"

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ যখন তুঙ্গে, তখন মূলধারার একাধিক সংবাদমাধ্যমে এই গল্প প্রচারিত হয়। পাঠকদের কাছ থেকে বিডি ফ্যাক্টচেক ফেসবুক পেইজে অনুরোধ আসে খবরটি সত্য কিনা যাচাই করে দেখতে। বিডি ফ্যাক্টচেকের অনলাইন ইনভেস্টিগেটররা অনুসন্ধান শেষে অল্পক্ষণের মধ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে জানানো হয়, খবরটি ভুয়া। চীনের মিডিয়ায় উহানের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি, সেখানকার মানুষদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার তথ্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে দেখানো হয়, এভাবে গরম পানি পান করে বা ভাপ নিয়ে করোনাভাইরাস বিনাশ করা যায় না। বরং ভাইরাস বিনাশ করতে যেই তাপমাত্রার প্রয়োজন সেটি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি এবং তা পানযোগ্য নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এ সংক্রান্ত গুজব প্রতিরোধে যখন চূড়ান্ত গুরুত্বারোপ করছিল, তখন বাংলাদেশে এভাবেই ভুয়া খবর ও গুজব চিহ্নিত করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছে বিডি ফ্যাক্টচেক।

গত ১০ মাসে করোনা সংক্রান্ত দেড় শতাধিক গুজব ও ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে দেশের প্রথম এই ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা। এর বেশিরভাগ ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়ালেও গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ ছড়িয়েছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে। যেমন করোনা নিয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর ভুয়া বক্তব্য, করোনার কারণে চীনে আড়াই কোটি মানুষের গায়েব হয়ে যাওয়ার বিভ্রান্তিকর খবর, করোনাভাইরাস মানুষের তৈরি বলে জাপানি বিজ্ঞানীর ভুয়া বক্তব্যসহ নানা ভুল ও বিভ্রান্তিকর খবর বহুল পঠিত বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে ৩০০টির বেশি গুজব চিহ্নিত করেছে বিডি ফ্যাক্টচেক। এ ছাড়া মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধিতে নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রকাশ করা হয়ে থাকে। 

গুজবের বিরুদ্ধে নিরন্তর এই যুদ্ধের শুরু ২০১৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম এই ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা। সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক কদরুদ্দীন শিশির জানান, প্রথমে একটি ফেসবুক পেইজ হিসেবে শুরু করেন তারা। এরপর মানুষের আগ্রহ দেখে ওয়েবসাইট করা। বর্তমানে এটি একটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের কাজ হচ্ছে গুজব চিহ্নিত করা, সেগুলো মানুষকে জানানো এবং সাধারণের মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধিতে নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। 

প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেইজে ৭০ হাজারের বেশি ফলোয়ার রয়েছেন। তারা প্রতিদিন সেখানে কোনো না কোনো গুজব সম্পর্কে জানতে পারেন। এছাড়া ওয়েবসাইটে  নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক প্রতিবেদন। ওয়েবসাইটের বাইরেও ফ্যাক্ট চেকিং কনটেন্ট প্রকাশিত হয় ফেসবুক পেইজে। 

বিডি ফ্যাক্টচেক বেশ কয়েকটি দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজ করেছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থার (ইউএনডিপি) আয়োজনে ডিজিটাল খিচুড়ি চ্যালঞ্জ-২০২০-এ চ্যাম্পিয়ন হয় বিডি ফ্যাক্টচেক। এখান থেকে প্রাপ্ত অনুদানের ভিত্তিতে কোভিড স্টিগমা ও মিসইনফরমেশন বিষয়ে একটি সচেতনতা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের নামকরা ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণে সামাজিক মাধ্যমে ক্যাম্পইনটি পরিচালিত হয়। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে এ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বার্তা।

এ ছাড়া সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা এমআরডিআই ও সুইডেন ভিত্তিক ফয়ো মিডিয়া ইনস্টিউটের সাথে যৌথভাবে মিসইনফরমেশন বিষয়ক সচেতনতায় একাধিক ক্যাম্পেইন চালিয়েছে বিডি ফ্যাক্টচেক। তরুণ সাংবাদিকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সামনে আরো প্রশিক্ষণ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।

বিডি ফ্যাক্টচেক বিগত দুটি আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় মিসইনফরমেশন মোকাবেলায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন আয়োজন পর্যবেক্ষণে ৩১টি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হয় যাদের অন্যতম ছিল বিডি ফ্যাক্টচেক।

বিডি ফ্যাক্টচেকের প্রশিক্ষিত টিমের সদস্যরা সার্বক্ষণিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির সহায়তা দেন। যেসব পোস্ট বা প্রতিবেদন বেশি ছড়াচ্ছে বা ভাইরাল হচ্ছে সেগুলো যাচাই বাছাই করেন তারা। কোনো তথ্য, ছবি বা ভিডিও বিভ্রান্তিকর বা ভুল হিসেবে চিহ্নিত হলে দলিলপ্রমাণসহ সেগুলো ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেইজে তুলে ধরেন। যে কেউ তাদের ফেসবুক পেইজের ইনবক্সে যে কোনো খবর যাচাইয়ের অনুরোধ করতে পারেন। যাচাইযোগ্য হলে এবং সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করা গেলে সে ব্যাপারে জানানো হয়।

বিডি ফ্যাক্টচেকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাহেদুর রহমান আরমান বলেন, “ভুল তথ্য সমাজে-রাষ্ট্রে  বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায্যতা তৈরি করে। ভুয়া খবরের কারণে অনেক মানুষ ব্যক্তিগতভাবেও কল্পনাতীত ক্ষতিগ্রস্ত হন। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, ধর্মীয় উগ্রতা এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাও তৈরি করে। তাই ভুল তথ্য বা ভুয়া তথ্যের গোমর ফাঁস করে দিতে কাজ করছে বিডি ফ্যাক্টচেক। বিভ্রান্তিকর সংবাদ, লেখা, ছবি, ভিডিও যাচাই বাছাই শেষে তা প্রমাণসহ তুলে ধরি।” 

আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল মাহমুদ বলেন, "আমরা সব সময় দল মত গোষ্ঠির উর্ধ্বে উঠে কাজ করার চেষ্টা করেছি। শুধু মানুষ এবং বিষয়বস্তুর প্রতি সৎ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমাদের রয়েছে। এই দল ও মত নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা আমাদের সব সময় থাকবে।" 

ফেইক নিউজ চিহ্নিত করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধিকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন বিডি ফ্যাক্টচেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কদরুদ্দীন শিশির। তার মতে, "ফেইক নিউজ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ, মানুষের মধ্যে বিদ্যমান কনফারমেশন বায়াস। এটার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো গেলে, ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতে পারলে ফেইক নিউজ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। মানুষ যা দেখে বা শোনে তা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা এবং অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।" 

এ ছাড়া ফেইক নিউজ প্রতিরোধে মিডিয়ার অনলাইন সেকশনে কর্মরতদের অনলাইন কন্টেন্ট যাচাইয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি। 


সর্বশেষ সংবাদ